পরিবর্তন_Written By mblanc [তৃতীয় পর্ব - ৩.১ কিছু রোমন্থন]
পরিবর্তন
Written By mblanc
তৃতীয় পর্ব
।। ৩.১ ।।
কিছু রোমন্থন
দুটো সপ্তাহ কোথা দিয়ে উড়ে গেল।
অনুর পুরোপুরি সুস্থ হতে দিনতিনেক লেগেছিল। গায়ের ব্যাথা একদিনেই যায়, কিন্তু মনের ক্ষত বড় দায়। সেদিন - আমাদের "নতুন ফুলশয্যার" দিন - প্রায় দুপুর অবধি মিলনে বিদ্ধস্ত হবার পরও দেখি উঠে পড়ে রান্নাঘরে খুটখাট শুরু করেছে। এক ধমক দিতেই সুড়সুড় করে সোফার কোনে মিলিয়ে গিয়েছিল; এমনকি গায়ে কাপড় দেবার কথাও বলতে হয়েছিল।
আর ওর তৃষ্ণার্ত দৃষ্টি - সারাক্ষণ আমাকে ফলো করে বেড়িয়েছে। যেন এক মিনিট না দেখলে হাওয়ায় মিলিয়ে যাব। কিন্তু বারণ যে করব, তার জোরও পাচ্ছিলাম না ওর মুখের দিকে তাকিয়ে। তার বদলে যতটা সম্ভব সময় ওর কাছে থেকেছিলাম। অর্ডার দিয়ে আনানো খাবার প্রথম দিন খাইয়ে দিতে হয়েছিল।
পরে বুঝেছিলাম, শারীরিক ধর্ষণ ওর গায়েই লাগেনি - যেটা আসলে হয়েছিল তা হল মানসিক ধর্ষণ।
সেদিন আর তার পরদিন ল্যাবে যাই নি, বার বার দীপালির ফোন আসা সত্ত্বেও। কিন্তু তার পর আর উপেক্ষা করা যায় নি - যতই হোক, আমি একটা চাকরি করি। অনুকে মোটামুটি স্টেবল দেখে তৃতীয় দিন ল্যাবে ফিরেছিলাম। ঢুকে মনে হয়েছিল যেন স্টেজে উঠে স্পটলাইটের তলায় দাঁড়িয়েছি - দীপালির জ্বলন্ত ক্ষুধার্ত দৃষ্টি, জুনিয়রদের কারো কৌতূহলী, কারো তামাশা-ভাবের দৃষ্টি সর্বক্ষণ আমার দিকে।
যাইহোক, এ ক’দিনে অনেকগুলো উন্নতি হয়েছে।
প্রথমত, আমার ফর্মুলার খুব গভীর অ্যানালিসিস চালিয়ে যা তথ্য পেয়েছি, সেটাকেই একটু আগড়ুম-বাগড়ুম করে নতুন রিপোর্ট করেছি - যাতে বিশ্বাসযোগ্য ভাবে দেখানো গেছে যে একটা কিছু বিরাট ব্রেকথ্রু শীগগিরই হতে যাচ্ছে আমাদের গবেষণায়। এতে করে অন্তত দুমাসের জন্য শ্রীনিবাসনের মাথায় টুপি পরানো গেল আর আমাদের ল্যাবের ভবিষ্যৎ বিপদ কিছুদিনের জন্য হলেও সরানো গেল।
আরো একটা জিনিস এই বেরিয়ে এল যে, ঐ সেক্স ককটেল-এর আরো একটা প্রভাব আছে যা সহজে দেখা যায় না। আমি অবাক হতাম এই ভেবে যে দীপালি বা অনু দুজনেই চারিত্রিক ভাবে যথেষ্ট দৃঢ় মহিলা, আমার সামনে এরকম তাসের ঘরের মত ভেঙ্গে পড়ল কী ভাবে। তার কারণটা বেরিয়ে এল একটা সারা-রাত্রিব্যাপী বায়োকেমিক্যাল নিরীক্ষার থেকে। দেখা যাচ্ছে, এই ফর্মুলা মানুষের গায়ের ঘামের গন্ধ পালটে দেয়। তাতে কী লাভ? লাভ এই যে ঘামের মধ্যে গন্ধের বদলে একটা নতুন 'ফেরোমোন' ছাড়তে থাকে। ফেরোমোন হল একধরনের "বায়ুবাহী সঙ্কেত" – পিঁপড়েরা ফেরোমোনের সাহায্যের একে অপরকে দিকনির্দেশ করে, সঙ্কেত দেয় কোথায় খাবার, কাকে কখন কামড়াতে হবে। বেশীরভাগ বন্য প্রাণীই ফেরোমোনের গন্ধ শুঁকে বোঝে কোন মাদীটা গরম হয়েছে, বা অন্য কারোর শিকারের এলাকায় ঢুকে পড়ল কী না। মানুষের ক্ষেত্রে ফেরোমোনের ব্যবহার নেই বললেই চলে (দরকার আছে বলে মনেও হয় না) - কিন্তু এই ফেরোমোন ভাদ্রমাসের কুকুরের মতোই হরমোনের গ্রন্থি গুলোর ওপর ম্যাজিক করে। মানসিক নয় – অতিশয় বন্যভাবে শারীরিক। শুধু এইটা জানা গেল না যে যেমন ফিমেল গ্ল্যান্ডের ওপর কাজ করে তেমনি মেল গ্ল্যান্ডের ওপরেও কাজ করে কী না। যাই হোক, আমি অন্তত সে পরীক্ষা করতে যাচ্ছি না - আমি ছাড়া এ ওষুধ আর কারোর নয়। কারো না!
শুধু একটা ছোট গোলমাল হতে পারে। অ্যানালিসিসটা করবার সময় সুজাতার সাহায্য নিতে হয়েছিল বাধ্য হয়ে। যতক্ষণ লেগে ছিল পুরো সময়টাই ওর কপালে খাঁজ দেখেছি। ছোট্ট মিষ্টি খাঁজ, বাচ্চা মেয়েদের পুতুল না দিলে যেমন করে কপালে ভাঁজ তুলে ঠোঁট ফোলায় ঠিক তেমনি, কিন্তু বিপজ্জনক। মেয়েটা ব্রিলিয়ান্ট। কিছু একটা করতে হবে ওর মন ঘোরানোর জন্যে।
মুখে বলা এক, কাজটা করে ফেলা আর এক। অনেক ভেবেও কিছু ঠিক করে উঠতে পারছিলাম না। আর কী করেই বা পারব – শান্তিতে দুদণ্ড একটু বসে ভাবব তার জো আছে? হয় কাজ, নয় বাড়িতে অনুর কাছে থাকলে এসব কথা মাথায় আসে না। আমার সামনে অনুর ভাবভঙ্গি এখন কিছুটা পোষা কুকুর আর কিছুটা বিড়ালের মত। ভক্তি আর যৌনতা একসাথে মেশালে হেরোইনের চেয়ে কড়া মাদক। অন্য কিচ্ছু মাথায় আসে না।
সে যাইহোক, ল্যাবেও কিছুক্ষণ নিজের মত বসে চিন্তাভাবনা করার উপায় নেই। সেখানে দীপালির চোখজোড়া আমাকে ফলো করে বেড়ায় সর্বক্ষণ সার্চলাইটের মত। নাঃ, ওর একটা কিছু বিহিত করতে হবে।
এ তো ভালো মজা, সেদিন বাড়ি ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম। এতদিন এক নারীকে নিয়েই এত ব্যস্ত ছিলাম, অন্য কারোর কথা মাথায় আসেনি। আজ সেই নারী বশ হতেই অন্য দুই নারীকে নিয়ে এত চিন্তা? আবার, যতদিন স্ত্রীর প্রতি বিশ্বস্ত ছিলাম ততদিন অসুখী, লাম্পট্যের সূচনার সাইড এফেক্ট হল সুখী গৃহকোণ? হা, হা, হা! এ বিষয়ে আমাদের সো-কলড গুরুজনেরা কী বলেন?
ফোন বেজে উঠল। তুলে দেখি আর এক নারীর ফোন। গুরুজনও বটে। সুনন্দাদি।
- "হ্যালো দিদি! কেমন আছো?"
- "দীপু? দীপু, ভাল আছিস ভাই? সব ঠিকঠাক তো?"
- "খুবই ভাল আছি দিদি। সব ঠিকঠাক হয়ে গেছে - অলমোস্ট। সরি তোমাকে বলতে ভুলে গেছিলাম, সরি, ট্রুলি সরি!"
- "আমি কিছু মনে করিনি রে। কী হয়েছিল একটু বলবি? মানে, যদি কিছু অসুবিধা না থাকে?"
গসিপ পেলে আর মেয়েরা আর কিছু চায় না, মনে মনে হাসলাম। বিশেষতঃ যদি হয় নোঙরা গসিপ! কিন্তু সুনন্দাদির প্রতি আমার অনেক ঋণ শোধ করার আছে। আর ও ঠিক পাড়াবেড়ানি টাইপ নয় – ওকে বলাই যেতে পারে। অন্তত, রূপকথার অংশটুকু বাদ দিয়ে।
- "দিদি, তুমি কি বাড়ি আছ?"
- "এইমাত্র ফিরেছি। এবার রান্নাবান্না করব।"
- "কোরো না।"
- "অ্যাঁ? রান্না করব না? সেকিরে, কেন?"
- "কারণ আমি যাচ্ছি তোমার ফেভারিট নিয়ে। হাক্কা নুডলস আর সুইট-অ্যান্ড-সাওয়ার চিকেন। আজ আমাদের রোমান্টিক ডিনার!"
সুনন্দাদি একটুক্ষণ চুপ করে রইল। "তুই খুব দুষ্টু ছেলে, জানিস তো!"
- "দিদি, আমার বয়স চার কুড়ি হতে যাচ্ছে! এখনো 'দুষ্টু ছেলে' বলছো?"
- "আমার কাছে তুই চিরকালের খোকাটি।"
এমনভাবে কথাটা বলল দিদি, আমার কেমন যেন মন কেমন-কেমন করে উঠল। মা মারা গেছেন অনেকদিন, স্নেহ জিনিসটা ঠিক কেমন হয় স্বাদ গেছি ভুলে। এই দিদিটাই বার বার মনে করিয়ে দেয়।
- "কীরে চুপ করে গেলি যে? কখন আসছিস?"
- "এই আসছি দিদি। দরজা খোলা রেখো!"
- "হ্যাঁ, দরজা খুলে রাখি হাঁ করে আর ডাকাতে এসে আমাকে তুলে নিয়ে যাক আর কী!" হেসে ফোন কেটে দিল সুনন্দাদি।