পাপ কাম ভালোবাসা_Written By pinuram [ঊনত্রিংশ পর্ব (চ্যাপ্টার ০৭ - চ্যাপ্টার ০৮)]
পাপ কাম ভালোবাসা
Written By pinuram
পর্ব ২৯ (#০৭)
রূপক উত্তর দেয়, "অগ্নিহোত্রীর বাবা, সমীর বাবু।"
অনুপমার মনে পড়ে যায় পায়েলের অপহরনের ঘটনা। পায়েলের পিসির ছেলে, বিনয় আর তার বন্ধু অগ্নিহোত্রী পায়েলকে অপহরন করে নৈহাটি নিয়ে গিয়েছিল। রূপক দেবায়ন দলবল নিয়ে গিয়ে পায়েলকে বাঁচিয়ে এনেছিল, কিন্তু অগ্নিহোত্রীর বাবা কেন ওদের মারতে চায় সেটা ঠিক বুঝতে পারে না তাই জিজ্ঞেস করে, "সমীর বাবু কেন তোদের মারতে চায়?"
রূপক উত্তর দেয়, "আসলে সেদিন অগ্নিহোত্রী আর বিনয় পালায়নি। দেবায়ন সেইদিন ওদের খুন করে দিত। কিন্তু আমরা সবাই বাধা দিয়েছিলাম তাই আর দেবায়ন খুন করেনি। কিন্তু অগ্নিহোত্রী বেঁচে যাবে সেই দেখে আমার আর দেবায়নের খুব দুঃখ হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত একটা নকল পলাতকের ঘটনা তৈরি করা হয় আর ফাঁকা মাঠে ওদের ছেড়ে দেওয়া হয়। ওরা যখন পালাতে যায় তখন নিরঞ্জন বাবু ওদের পলাতক ঘোষণা করে গুলি করেন। যাকে পুলিসের ভাষায় এনকাউন্টার বলে।"
অনুপমার কাছে এইবারে সব কিছু পরিষ্কার হয়ে যায়। নিরঞ্জন বাবু বলেন, "এইবারে সমীর বাবুকে হাতেনাতে ধরতে হবে। এখন পর্যন্ত ওনার বিরুদ্ধে অকাট্য প্রমান পাওয়া যায়নি। আর সমীর বাবু সেই ছেলেটাকেও খুন করেছে সুতরাং এই কেস উত্তরাখন্ড পুলিসের কাছেও যাবে। আমি একবার রোহনকে ফোন করে দিচ্ছি আর সেই সাথে বাগডোগরা গিয়ে ফ্লাইটের প্যাসেঞ্জার লিস্ট দেখলে সব পরিস্কার হয়ে যাবে।"
রূপক জিজ্ঞেস করে, "কিন্তু কি করে ধরব?"
অনুপমা খানিক চিন্তা করে বলে, "এইবারে আমাদের চাল চালতে হবে, ফাঁদ আমাদের পাততে হবে। তোর কাছে যে ইমেল গুলো এসেছিল সেই ইমেল গুলোর সেন্ডার আই.পি. এড্রেস দেখ। মনে হয় ওই আই.পি. অ্যাড্রেস থেকে সার্ভিস প্রোভাইডারের খবর পাওয়া যাবে, সেই থেকে অনায়াসে আমরা ওই আই.পি. অ্যাড্রেসের লোকেসান বের করে নিতে পারব। এর পরে তুই ওই ইমেলে একটা উত্তর দে, যে কোন এক দুর্ঘটনা জনিত কারনে তোদের খাটলিং ভ্রমন সুখকর হয়নি। সমীর বাবু তাহলে ধরতে পারবেন না যে আমরা তাকে সন্দেহ করেছি। তুই ধন্যবাদ জানিয়ে লেখ যে তুই ওর সাথে দেখা করতে চাস। আমি হলফ করে বলতে পারি একা একা দেখা করার কথা শুনে এই ফাঁদে সমীর বাবু পা দেবেন আর তিনি তোকে মারার জন্য তৈরি হয়েই আসবেন।"
শ্রেয়া আঁতকে ওঠে, "না ও একা যাবে না আমিও যাবো।"
নিরঞ্জন বাবু হেসে বলেন, "ও অথবা তুমি কেউই একা যাবে না। আমি নৈহাটি থানায় ফোন করে বলে দিচ্ছি সমীর বাবুর ওপরে নজর রাখার জন্য। যদি সমীর বাবু ফাঁদে পা দেয় তাহলে আমরা সবাই ওর পিছু নেব। হাতেনাতে ধরতে পারলে ওর বিরুদ্ধে আর বেশি প্রমানের দরকার নেই। একবার আমার হাতে পরুক তারপরে ওর মুখ থেকে কি করে কবুল করাতে হয় সেই উপায় আমাদের বেশ ভালো ভাবেই জানা আছে।"
নিরঞ্জন বাবু নৈহাটি থানায় ফোন করে সমীর বাবুর বাড়ির ওপরে নজর রাখতে বলে দেয়। সেই সাথে বাগডোগরা এয়ারপোর্টে ফোন করে এয়ারপোর্ট ম্যানেজারের সাথে কথা বলে ফ্লাইটের লিস্ট জানতে চান। তিনি জানান সকালের ফ্লাইট সব চলে গেছে এরপরের ফ্লাইট বিকেল পাঁচটায়। নিরঞ্জন বাবু ওদের বলেন তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে পড়লে এয়ারপোর্ট পৌঁছান যাবে, কিন্তু প্রমান ছাড়া গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা যাবে না। সুতরাং ওদের শুধু মাত্র অনুসরন করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। লাভা থেকে গাড়ি নিয়ে সবাই কোলকাতার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পরে। বাগডোগরাতে নিরঞ্জন বাবু একজন অফিসারকে নামিয়ে দিয়ে ফ্লাইটে করে সমীর বাবুকে অনুসরন করতে বলে দেন। তারপরে ওরা সবাই কোলকাতার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পরে। পথে যেতে যেতে ল্যাপটপ খুলে রূপক ওর ইমেল দেখতে বসে যায়। ইমেল থেকে সেন্ডার আই.পি. এড্রেস বের করে ট্রেস করে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারের নাম বের করে ফেলে। নিরঞ্জন বাবু সেই সারভিস প্রোভাইডারকে ফোন করে নিজের পরিচয় আর খুনের তদন্ত করছেন জানিয়ে আই.পি. এড্রেসের ঠিকানা জানতে চায়। সার্ভিস প্রোভাইডার জানায়, এই আই পি এড্রেস ডাটা কার্ডের, ওদের ডেটাবেস খুঁজে সমীর বাবুর নাম ঠিকানা পেয়ে নিরঞ্জন বাবুকে জানায়। রূপক সাথে সাথে একটা ইমেল করে দেয় যে এক দুর্ঘটনার জন্য ওদের ট্রেকিং সুখকর হয়নি, কিন্তু সুন্দর একটা জায়গার খবর দিয়েছে বলে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে। সেই সাথে আরো লেখে যে রূপক এই আগন্তুকের সাথে দেখা করতে চায়। ওইদিকে যে অফিসার বাগডোগরা এয়ারপোর্টে থেকে গিয়েছিল সে ফোন করে জানিয়ে দেয় ওদের ধারনা অনুযায়ী সমীর বাবু ফ্লাইটে করেই কোলকাতা ফিরছে। ওদের কোলকাতা ফিরতে বেশ রাত হয়ে যাবে, তাই সেই অফিসারকে ফ্লাইটে করেই সমীর বাবুকে অনুসরন করে কোলকাতা ফিরতে নির্দেশ দেয়।
কোলকাতা ফিরতে ওদের মধ্যরাত হয়ে যায়। অনুপমাকে একা বাড়িতে ফিরতে দেয় না শ্রেয়া। ওকে সঙ্গে নিয়ে নিজের বাড়িতে চলে যায়। ব্যাঙ্গালোরে ফোন করে মামনিকে মাকে বাকি সবাইকে জানিয়ে দেয় যে আততায়ীকে খুঁজে পাওয়া গেছে। সেই শুনে সবাই বেশ খুশি কিন্তু দেবায়নের শারীরিক অবস্থার উন্নতির খবর নেই শুনেই অনুপমা মুষড়ে পড়ে। রূপক, শ্রেয়া আর অনুপমাকে ব্যাঙ্গালোর দেবায়নের কাছে চলে যেতে অনুরোধ করে। এবারে যখন আততায়ীর আসল পরিচয় জানা গেছে আর নিরঞ্জন বাবু সাথে আছেন তাহলে সমীর বাবুকে ধরতে ওদের কোন অসুবিধে হবে না। শ্রেয়ার সাথে থাকলেও ওর মন পড়ে থাকে দেবায়নের কাছে।
রাতের বেলা চোখের পাতা এক করতে পারে না অনুপমা। একা বিছানায় শুয়ে বালিশে মুখ গুঁজে নীরবে বুকের অশ্রু ঝরায়। কি পাপ করেছে দেবায়ন যে ওকে এই মর্মান্তিক অবস্থার মধ্যে পড়তে হল? দেবায়ন কখন দোষ করেনি, বরং সবার ভালোই চেয়ে এসেছে। ওদের পরিবারের মধ্যে, বাবা মায়ের মধ্যে, ওর আর মায়ের মধ্যে যে কঠিন দেয়াল এতদিনে গড়ে উঠেছিল সেটা ভেঙ্গে দিয়েছে। ওর সব থেকে ভালো বান্ধবী পায়েলকে বাঁচিয়ে এনেছে। একটা হারিয়ে যাওয়া প্রেমকে চাগিয়ে তুলেছে। ওর এক ভাই আছে সেটা জানত না, তাকেও খুঁজে বের করেছে আর অতি সুকৌশলে ওর সাথে নিবেদিতার বন্ধুত্ব করিয়েছে যাতে ভবিষ্যতে ওদের মাঝে কোন দ্বন্দ না হয়। তাহলে কোন পাপের শাস্তি পেয়েছে ওর পুচ্চু।
সকাল বেলায় শ্রেয়া আর নিজের জন্য ব্যাঙ্গালোরের টিকিট কাটে। খাবার টেবিলে শ্রেয়ার বাড়ির লোকের সাথে দেখা হয়। সবাই দুঃখ ব্যাক্ত করে। শ্রেয়া সবাইকে জানিয়ে দেয় কেউ যেন কোন দুঃখ না প্রকাশ করে, দেবায়ন ভালো আছে, দেবায়ন ভালো হয়ে আবার অনুপমার কাছে ফিরে আসবে।
অনুপমা আর শ্রেয়া দুপুরের পরে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়ে। রূপক ওদের এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিতে এসেছিল।
গাড়িতে যাওয়ার সময়ে অনুপমা শ্রেয়াকে জিজ্ঞেস করে, "হ্যাঁ রে, ওই পঞ্চাশ লাখ টাকা কোথা থেকে যোগাড় করলি বললি না তো?"
শ্রেয়া স্মিত হেসে বলে, "তোর জেনে কি দরকার।"
অনুপমার জোরাজুরির পরে শ্রেয়া উত্তর দেয়, "রূপক আর আমি পাগলপ্রায় হয়ে গিয়েছিলাম আততায়ীর খবর জানার জন্য কিন্তু আমাদের হাতে অত টাকা নেই। ফোন করলাম সব বন্ধু বান্ধবীদের, যার যতটা ক্ষমতা সে ততটা দিল, ধীমান, প্রবালের কাছ থেকে দুই লাখ টাকা, সঙ্গীতা আর তনিমা এক লাখ করে দিল। আমার কাছে তিন সাড়ে তিনের মতন ছিল কিন্তু তাতেও কুলায় না।"
কথা গুলো শুনতে শুনতে অনুপমার চোখে জল চলে আসে। ওর পাশে সত্যি অনেকে দাঁড়িয়ে কিন্তু এত ভিড়েও যে অনুপমা একা, বড় একা। দেবায়ন পাশে না থাকলে এই ভিড় এই বন্ধু বান্ধবী এই সুখ দিয়ে কি করবে? শ্রেয়া তারপরে বলে, "রূপকের কাছে পাঁচ লাখ টাকা ছিল কিন্তু সব মিলিয়ে পঞ্চাসের কাছাকাছিও যাচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত রূপক একজনের কাছে হাত পাতে। সেই অবশ্য আমাদের সবার টাকা ফেরত দিয়ে নিজেই পঞ্চাশ লাখ টাকা আমাদের দেয়।"
অনুপমা উৎসুক হয়ে প্রশ্ন করে, "কে দিয়েছে?"
রূপক স্মিত হেসে বলে, "না রে নাম বলা বারন, তাই বলতে পারছি না। তবে ওই নিয়ে চিন্তা করিস না, তুই নিশ্চিন্ত মনে ব্যাঙ্গালোর যা আর দেবায়নকে ফিরিয়ে নিয়ে আয়। এইবারে তোদের বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত তোদের চোখে চোখে রাখব, যেমন ভাবে বেহুলা লক্ষিনদরকে আটকে রাখা হয়েছিল ঠিক সেই মতন এক বাড়ি বানিয়ে তোদের রেখে দেব।"
অনুপমার চোখ জোড়া ছলকে ওঠে, শ্রেয়া ওকে প্রবোধ দিয়ে বলে, "প্লিস সোনা কাঁদিস না আর, আমার মন বলছে দেবু এইবারে ঠিক উঠে দাঁড়াবে।"
অনুপমা ধরা কণ্ঠে বলে, "এইবারে না ওঠা পর্যন্ত আর আমি ওর পাশ ছাড়ব না।"
ব্যাঙ্গালোর পৌঁছাতে ওদের বিকেল হয়ে যায়। দিলিপ বাবু ওদের জন্য গাড়ি পাঠিয়েছিল, এয়ারপোর্টে অঙ্কন ওদের নিতে এসেছিল। অঙ্কনের মুখে জানতে পারে যে দেবায়নের অবস্থা এখন আগের মতন, নাকে অক্সিজেনের নল, ওষুধপত্র সব কিছু আই.ভি. করে দেওয়া হচ্ছে, শ্বাসের গতি অতি ধীরে। পারমিতাকে কাছে পেয়ে দেবশ্রী একটু সুস্থ হয়েছেন না হলে এই কয়দিনে ছেলের এই অবস্থায় শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিলেন। দিলিপ বাবুর বাড়ি আর বাড়ি নেই, ছোট খাটো নার্সিং হোম হয়ে গেছে, সকাল বিকেল ডাক্তারদের আনাগোনা, সর্বদার জন্য তিনটে নার্স মোতায়ন করা।
বাড়িতে ঢুকে ওকে দেখে সবাই শুকনো মুখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। অনুপমা সোজা দেবায়নের ঘরে ঢুকে পড়ে। বিছানায় শায়িত নিস্তেজ একটা শরীর, কোন সারা শব্দ নেই, নড়ন চড়ন নেই, দুই চোখ বোজা, সারা শরীরে ব্যান্ডেজ বাঁধা। দিলিপ বাবু জানালেন, কোমা থেকে বেরিয়ে না আসা পর্যন্ত ডাক্তারেরা অপারেশান করতে পারছে না। সবাই বড় চিন্তায়, কেউ কিছু বুঝতে পারছে না কি ভাবে দেবায়নের জ্ঞান ফিরিয়ে আনবে। প্রেমিকার চেয়ে বেশি এক মায়ের হৃদয় তার এক মাত্র ছেলের জন্য বেশি ভেঙ্গে পড়েছে। তাও দেবশ্রী মন শক্ত করে অনুপমাকে শক্তির জোগান দেয়।
দেবশ্রী অনুপমাকে বলে, "এইবারে ওকে বাড়িতে নিয়ে যাবার ব্যাবস্থা করো। এইখানে দিলিপ বাবুর কাছে কত দিন রাখা যায় বল।"
অনুপমা মাথা দোলায়, হ্যাঁ এইবারে দেবায়নকে কোলকাতা নিয়ে যাওয়ার ব্যাবস্থা করা দরকার। সেই খবর শুনে দিলিপ বাবু জানিয়ে দিলেন যে ব্যাঙ্গালোরের ডাক্তারদের যখন শুরু থেকে দেখান হচ্ছে তখন দেবায়ন ঠিক না হয়ে যাওয়া পর্যন্ত তার বাড়িতে রেখে দেওয়া হোক। সোমেশ বাবু বলেন, যে দেবায়ন কবে এই কোমা থেকে চোখ খুলবে..... কথাটা বলে ফেলে বুঝতে পারলেন যে বড় ভুল করছেন। দেবশ্রী ছলছল চোখে ছেলের বিছানার এক পাশে বসে অন্যপাশে অনুপমা দেবায়নের নিস্তেজ হিমশীতল হাত নিজের হাতের মধ্যে ধরে বসে। দিলিপ বাবু জানিয়ে দেন, যতদিন না দেবায়ন চোখ খুলবে ততদিন তার সেই সামরথ আছে যে অনুপমা, দেবশ্রী দেবায়ন আর ওর চিকিৎসা সব করাতে পারবেন। দিলিপ বাবু আর কণিকা দেবী কিছুতেই ওদের যেতে দিতে নারাজ। শেষ পর্যন্ত সবাই হাল ছেড়ে দেয়।
দেবশ্রী বাদে বাকি সবার জন্য হোটেলে থাকার ব্যাবস্থা করা হয়। হোটেল অবশ্য বাড়ি থেকে বেশি দূরে নয় তাই সকালে উঠেই সবাই বাড়িতে চলে আসে। সারা রাত অনুপমা দেবায়নের হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে চুপচাপ বসে থাকে। সবাই যে যার ঘরে ঘুমিয়ে পড়েছে, রাতের ডিউটির জন্য যে নার্স কে রাখা হয়েছিল সে বসার ঘরে বসে একটা গল্পের বই পড়ছিল।
অনুপমা, দেবায়নের হাত নিজের হাতের মধ্যে ধরে আলতো করে নিস্তেজ হাতের মধ্যে হাতে বুলাতে বুলাতে কাতর কণ্ঠে কেঁদে ওঠে, "পুচ্চু, তুই আমাকে ছেড়ে যেতে পারিস না....." বারেবারে বলতে বলতে শেষ পর্যন্ত বিছানায় উঠে ওর বুকের ওপরে আছড়ে পড়ে। বুকের মধ্যে মাথা গুঁজে ডুকরে কেঁদে ওঠে, "পুচ্চু প্লিস সোনা একবার চোখ খোল....." বুকের ওপরে কান চেপে অতি ধীরে চলা হৃদপিণ্ডের ধ্বনি একমনে শোনে, হুপ হুপ হুপ হুপ..... ভয় হয় যদি এই শব্দ থেমে যায়।
কতক্ষণ ওইভাবে দেবায়নের বুকের ওপরে মাথা গুঁজে একমনে ওর হৃদয়ের ডাক শুনছিল সঠিক মনে নেই অনুপমার। তবে হটাত দেবায়নের হৃদয়ের ধ্বনি বেড়ে যাওয়াতে ওর সম্বিত ফেরে, সেই সাথে একটা যান্ত্রিক টিঁ টিঁ টিঁ আওয়াজে বেজে। হৃদয়ের ধুকপুকানির শব্দ বেড়ে উঠতেই অনুপমা সতর্ক হয়ে দেবায়নের বুক থেকে উঠে ওর মুখের দিকে তাকায়। বন্ধ চোখের পাতা ঝরা পাতার মতন ধীরে ধীরে নড়ে ওঠে। হিমশীতল শরীরে উত্তাপের সঞ্চার হয়।
অনুপমা ডাক ছেড়ে কেঁদে ওঠে, "কাবেরি" নার্সের নাম কাবেরি।
ওর ডাক শুনে সঙ্গে সঙ্গে নার্স, দেবশ্রী দিলিপ বাবু কণিকা দেবী সবাই দৌড়ে আসে। কাবেরি, সঙ্গে সঙ্গে দেবায়নকে পরীক্ষা করে, দেবায়নের হাত একটু একটু করে নড়ে ওঠে, চোখের পাতা নড়ে ওঠে। অনুপমার চোখ জোড়া ভরে আসে জলে। অবশেষে ওর হৃদয় ডানা মেলেছে। নার্সের চেহারায় উদ্বিগ্ন ভরা। দেবায়ন বহু কষ্টে চোখ খুলে সবার দিকে তাকায়। দেবশ্রী ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে কেঁদে ফেলে। দেবায়ন আলতো মাথা দুলিয়ে মাকে কাছে ডাকে। দেবশ্রী দৌড়ে গিয়ে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে।
বহু কষ্টে দেবায়ন মায়ের কানে কানে বলে, "মা," ছেলের মুখে অনেক দিন পরে "মা" ডাক শুনে দেবশ্রী কেঁদে ফেলে, "হ্যাঁ বাবা বল, এই তো আমি।"
দেবায়ন অতি কষ্টে ফিসফিস করে মায়ের কানে বলে, "বাবা চকলেট দিতে চেয়েছিল মা, কিন্তু তোমাকে একা ফেলে যেতে পারলাম না মা।"
ছেলেকে বুকে জড়িয়ে কেঁদে ফেলে দেবশ্রী।
সবার চোখে জল চলে আসে। অনুপমা ওর পাশে বসে ওর হাত ধরে কেঁদে ফেলে, "পুচ্চু....."
নিঃশ্বাস নিতে একটু কষ্ট হয় দেবায়নের তাও বহু কষ্টে অনুপমার কানেকানে বলে, "তুই....."
অনুপমা ধরা কণ্ঠে বলে, "আর তোকে ছেড়ে যাবো না কোথাও।"
কাবেরি সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারদের ফোন করে দেয়। সেই রাতেই ডাক্তারেরা দিলিপ বাবুর বাড়িতে ওকে দেখতে চলে আসে। দিলিপ বাবু সোমেশ, পারমিতাকেও ফোন করে জানিয়ে দেয় যে দেবায়নের জ্ঞান ফিরে এসেছে। রাতের মধ্যে দিলিপ বাবুর বাড়িতে লোক জনের সমাগম বসে যায়, খুশির ছোঁয়া লাগে সবার বুকে। অবশেষে দেবায়ন আবার ওদের মাঝে ফিরে এসেছে। ডাক্তারেরা পরীক্ষা করে জানায়, এইবারে অপারেশান করা যেতে পারে। দেবায়নের ডান পায়ের হাড় ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। হাড়ের বদলে স্টিল রড অথবা টাইটেনিয়াম রড বসাতে হবে, না হলে দেবায়ন আর কোনোদিন হাঁটতে পারবে না। সেই শুনে সবাই চিন্তিত হয়ে পরে। টাইটেনিয়াম রড বসাতে অনেক খরচ পরে যাবে বলে ডাক্তারেরা জানায়। টাকার ব্যাপারে সেই সময়ে কারুর মাথা ব্যাথা ছিল না। দিলিপ বাবু, সোমেশ বাবু স্বমস্বরে জানিয়ে দেয় টাকার চেয়ে দেবায়নের উঠে দাঁড়ানো ওদের কাছে বেশি জরুরি। বেশ কিছুক্ষণ আলোচনা করার পরে দেবশ্রী জানায় হাড়ের বদলে টাইটেনিয়াম রড বসানোর জন্য। দিন দুইয়েক পরে দেবায়নের পায়ের অপারেশান করা হয়। তারপরে ওর শরীরে বেশ কয়েক জায়গায় অপারেশান করা হয়, শিরদাঁড়ার, হাতের। এই অপারেশান করতে করতে আরও বেশ কয়েকদিনে লেগে যায়। ডাক্তারেরা জানায়, দেবায়নের উঠে দাঁড়াতে বেশ সময় লাগবে। কোলকাতা ফিরে যেন এক ফিজিওথেরাপিস্ট নিযুক্ত করে যাতে দেবায়ন আবার চলাফেরা করতে পারে। দেবায়ন চোখ খোলার পরেরদিন শ্রেয়া কোলকাতায় খবর দিয়ে জানিয়ে দেয়।
সোমেশ বাবুর অফিস আর অঙ্কনের কলেজের পড়াশুনার ব্যাঘাত ঘটার জন্য অনুপমা ওদের বাড়ি ফিরে যেতে বলে দেয়। সোমেশ বাবু, অঙ্কন আর পায়েলকে নিয়ে কোলকাতা ফিরে আসে।
পর্ব ২৯ (#০৮)
বেশ কয়েকদিন পরে রূপক ব্যাঙ্গালোর চলে আসে। ততদিনে দেবায়ন বেশ সুস্থ হয়ে ওঠে কিন্তু তাও শয্যাশায়ী। দেবায়ন অনুপমাকে একদিন জিজ্ঞেস করে, "আমাকে কে ঠেলে দিয়েছিল রে, জানিস?"
অনুপমা মাথা দোলায়, "হ্যাঁ, আততায়ী এতদিনে ধরা পড়েছে। অগ্নিহোত্রীর বাবা সমীর বাবু।"
রূপক উত্তরে জানায়, আততায়ী শেষ পর্যন্ত ওদের জালে ধরা দেয়। রূপক ইমেল করে উত্তরে জানিয়েছিল যে কোন এক কারনে ওদের ট্রেকিং সুখকর হয়নি, কিন্তু ওই জায়গার সম্বন্ধে আগন্তুক ওদের খবর দিয়েছিল বলে রূপক ওর সাথে দেখা করে ধন্যবাদ জানাতে চায়। সমীর বাবু ভাবতে পারেনি যে রূপক ওকে চিনে ফেলবে তাই রূপকের ইমেলের উত্তরে তিনি জানিয়েছিলেন যে দেখা করবেন। সেই সাথে তিনি জানান যে তিনি বাঙালী নয়, উত্তর ভারতের লোক তাই মুসৌরির কাছে ধনোল্টি নামক এক জায়গায় দেখা করার কথা ব্যাক্ত করেন। রূপক, পরাশর, নিরঞ্জন বাবু, ঘন সিয়ালির ইনস্পেকটর রোহন সবাই তক্কেতক্কে ছিল। ওদের পরিকল্পনা মাফিক আগে থেকে নিরঞ্জন বাবু আর রোহন ধনোল্টি পৌঁছে যায় আর জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে থাকে। রূপক একাই ধনোল্টি যায় সমীর বাবুর সাথে দেখা করতে। সমীর বাবু, গোঁফ দাড়ি লাগিয়ে, নিজের পরিচয় লুকিয়ে পাঞ্জাবী সেজে ওর সাথে দেখা করতে আসে। সেইখানে রূপককে দেখে সমীর বাবু ছুরি বের করে রূপক কে আক্রমন করতে যায় আর সেই সময়ে রোহন আর নিরঞ্জন বাবু ওকে ধরে ফেলে। ধরা পড়ে যাওয়াতে সমীর বাবু মুষড়ে পরে। ছেলের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়া আর হল না। নিরঞ্জন বাবু বলেন, সমীর বাবুর ছেলে নিজের দোষে নিজের পাপে প্রান হারিয়েছে। অগ্নিহোত্রী পাপী, অগ্নিহোত্রী দোষী, দেবায়ন আর রূপক নয়।
ধরা পড়ার পরে সমীর বাবুকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদের সময়ে সমীর বাবু জানান, ছেলের মৃত্যুর পর থেকেই সমীর বাবু ফাঁক খুঁজছিলেন কি করে প্রতিশোধ নেওয়া যায়। তিনি কাউকে না জানিয়ে একাই এক বিশাল ষড়যন্ত্র রচনা করেন। নির্জন স্থান খোঁজার জন্য এক বছর ধরে বিভিন্ন দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে ঘুরে বেড়িয়ে কাটিয়ে দেন। তারপরে কম্পিউটার, ইন্টারনেট শেখেন যাতে রূপক অথবা দেবায়নের সাথে নিজের পরিচয় লুকিয়ে ইমেল করতে পারে। এই ট্রেকিং বিষয়ের বেশ কয়েকটা ইমেল দেবায়ন কে প্রথমে পাঠিয়েছিলেন সমীর বাবু, কিন্তু দেবায়ন তার কোন উত্তর দেয়নি দেখে পরে রূপকের কাছে পাঠায়। রূপক তার জালে ফেঁসে যায় আর উত্তরে জানায় ট্রেকিঙ্গে যেতে রাজি। ইমেলের মাধ্যমে রূপকের সাথে প্রথমে বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে আলোচনা চলে সমীর বাবুর, শেষ পর্যন্ত একটা ট্রেকিংয়ের সাইটের খবর দেয় সমীর বাবু। আগে থেকে সমীর বাবু সেই অয়েব সাইটে লগিন করে একটা ভুয়ো নামের একাউন্ট বানিয়ে রেখেছিলেন। রূপকের সাথে সেই ভুয়ো নামের একাউন্ট থেকে চ্যাটিং করেন আর এই ভাবে জানতে পারেন যে রূপক ঠিক কোথায় ট্রেকিংয়ে যাবে। সমীর বাবু ওদের ওপরে নজর রেখেছিল, আর আগে থেকেই একা একাই ঘুট্টু পৌঁছে গিয়েছিল। গা ঢাকা দেওয়ার জন্য তিনি জঙ্গলের মধ্যে তাঁবু খাটিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
নিউ তেহেরিতে, কুমার নামের পাহাড়ি ছেলেটার সাথে আলাপ হয়। তিনি কুমারকে সঙ্গে নিয়ে বলেছিলেন যে খাটলিং যেতে চায়। কুমারকে আসল উদ্দেশ্য জানায়নি সমীর বাবু, দেবায়ন আর রূপকের ছবি দেখিয়ে বলেছিলেন যে এদের একজনকে ডেকে আনতে আর ডেকে আনার পরে যেন পালিয়ে যায়। কুমার ওদের তাঁবুর কাছে গিয়ে দেবায়নকে ডাকে। সমীর বাবু ভেবেছিলেন, যেহেতু রূপক আর দেবায়ন ভালো বন্ধু সুতরাং দুইজনে একসাথেই আসবে। সমীর বাবু চেয়েছিলেন দুইজনকে একসাথে সেদিন রাতে খুন করবেন কিন্তু দেবায়ন একাই কুমারের সাথে আসে। তাই ওকেই প্রথমে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়। খুন করার আগে সব কিছু খুলে বলতে চেয়েছিলেন কিন্তু তার আগেই দেবায়ন ওই খাদের মধ্যে হারিয়ে যায়। তারপরে সমীর বাবু, জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে পাহাড় থেকে নেমে আসেন। কোলকাতা ফিরে খবরের কাগজে দেবায়নের নিখোঁজ হওয়ার খবর পড়ে নিশ্চিন্ত হয়ে যান।
এরপরে তক্কে থাকেন কি ভাবে রূপকের ওপরে প্রতিশোধ নেওয়া যায়। শেষ পর্যন্ত একদিন রূপককে চিঠি পাঠিয়ে জানায় যে তিনি দেবায়নের আততায়ীর খবর জানেন। রূপক সেই ফাঁদে পা দেবে সেটা নিশ্চিত ছিলেন। সমীর বাবু চেয়েছিলেন রাস্তার মধ্যেই রূপকের গাড়ির এক্সিডেন্ট ঘটাতে। সাধারনত লাভা যেতে সবাই কালিম্পং হয়েই যায় আর ভোরের দিকে রাস্তায় কুয়াশা থাকে। কিন্তু রূপক কালিম্পং হয়ে লাভা যায়নি দেখে মুষড়ে পড়েন। তিনি কোলকাতা ফিরে এসে আবার সুযোগের অপেক্ষা করেন। তারপরে রূপক ইমেল করে জানায় সে দেখা করতে চায়। ইমেল পড়ে সমীর বাবুর প্রত্যয় হয় যে রূপক এখন আসল আততায়ীকে চিনতে পারেনি। তাই তিনি নিজের পরিচয় একজন পাঞ্জাবী হিসাবে দিয়ে নির্জন ধনোল্টিতে দেখা করার কথা জানায়। তিনি ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারেন নি যে ওরা আগে থেকেই ওর পরিচয় জেনে ফেলেছে। কুমারকে হত্যা করার দায়ে আর দেবায়নকে খুন করার দায়ে রোহন সমীর বাবুকে গ্রেফতার। এই কেস উত্তরাখন্ডে ঘটেছে তাই উত্তরাখণ্ডের আদালতে এই মামলা চলবে।
পঞ্চাশ লাখ টাকার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে, রূপক কিছুতেই জানাতে নারাজ কোথা থেকে ওই টাকা যোগাড় করেছে। অনুপমার দৃঢ় প্রত্যয়, এক কথায় পঞ্চাশ লাখ টাকা দিয়ে দেবে এমন মানুষ শুধু মাত্র দুইজন আছে, এক ওর বাবা, কিন্তু বাবা দিলে ওর মা ওকে জানিয়ে দিত, আর দ্বিতীয় নিবেদিতা। কিন্তু অনুপমা যেটা বুঝে উঠতে পারে না, রূপক কেন নিবেদিতার কাছে গেল।
অনুপমা শেষ পর্যন্ত রূপককে বলে, "আমি জানি কে তোকে টাকা দিয়েছে।" রূপক জিজ্ঞেস করাতে অনুপমা উত্তর দেয়, "নিবেদিতা তোকে টাকা দিয়েছে, তাই না। কিন্তু নিবেদিতাকে তুই কোথায় পেলি?"
শেষ পর্যন্ত শ্রেয়া ওর হয়ে উত্তর দেয়, "আমাদের আর কিছু মাথায় আসছিল না, কোথায় যাবো কি করব কিছুই ভেবে উঠতে পারছিলাম না। শেষ পর্যন্ত নিবেদিতার কথা মনে পরে গেল। তুই অ্যানুয়াল মিটে সবার সামনে জানালি যে নিবেদিতা তোর ভালো বন্ধু। তাই ওর কাছে গিয়ে সব কিছু খুলে বলাতে সঙ্গে সঙ্গে পঞ্চাশ লাখ টাকা দিয়ে দিলেন আর সেই সাথে আমরা যারা যারা টাকা দিয়েছিলাম তাদের টাকা ফেরত দিয়ে দেওয়া হল।"
সব কিছু বলার পড়ে শায়িত দেবায়নকে দেখে রূপক ওকে বলে, "শালা তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়া, বিয়ে করতে হবে না?"
দেবায়নের হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে অনুপমা স্মিত হেসে বলে, "আর ওকে চোখের আড়াল করছি না।"
************ সমাপ্ত ************
********************************
**********************************