নিয়তির স্রোতস্বিনী_Written By SS_Sexy [চ্যাপ্টার ৪৯]

🔗 Original Chapter Link: https://chotiheaven.blogspot.com/2017/01/written-by-sssexy_80.html

🕰️ Posted on January 30, 2017 by ✍️ SS_Sexy

📖 2591 words / 12 min read


Parent
নিয়তির স্রোতস্বিনী Written By SS_Sexy (#৪৯) ডক্টর মুখার্জী কয়েক সেকেন্ড আমার মুখের দিকে চুপ করে চেয়ে থেকে বললেন, "মিনুদেবী, এ প্রসঙ্গে বলতে চাইলে অনেক কথাই বলা যায়। রীতিমত একটা ডিবেট করে ফেলা যায়। কিন্তু এ মূহুর্তে তেমন কিছু না করাই ভাল। তবে শুধু এটুকু শুনে রাখুন, আমি একজন ডাক্তার। ভদ্র হোক অভদ্র হোক, নোংরা পরিচ্ছন্ন যা-ই হোক, সব রুগীর চিকিৎসাই তো আমাদের করতে হয়। কোন রুগীকে ঘেন্না করলে আমাদের জীবিকাকেই অপমান করা হয়। আপনারা যেমন নিজেদের ব্যবসার স্বার্থে গ্রাহকের ভাল মন্দ বিচার করেন না। আমরাও ঠিক তেমনই রুগীর জাতপাত ভাল মন্দ বিচার করি না। তাই আমার মধ্যে ও’ ব্যাপারে কোনও দ্বিধাদ্বন্দ্ব নেই। আর আমার মিসেস মানে আদির মা, সে-ও যে এসব ব্যাপারে কতটা উদার, সেটা তো তার সাথে কথা না বললে বুঝতে পারবেন না। তবে তারও যে এতে কোন রকম আপত্তি হবে না, এটা আমিই জোর দিয়েই বলতে পারি। তাই আপনি যদি আমার ছেলের মুখে একটু খাবার তুলে দেন, তাতে আমি বা আমার স্ত্রী কেউই কিছু মনে করব না। বরং আমার ছেলের একটা সাধ পূরণ করলে আমাদের ভালই লাগবে।" আমি আবার কিছু বলতে যেতেই ডাক্তার হাত উঠিয়ে আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, "আপনারা দু’জন আজ হয়ত এমন পরিবেশে আছেন। কিন্তু চিরদিন তো তা ছিলেন না মিনুদেবী। কোন না কোন সময়ে আপনারাও নিশ্চয়ই নিজেদের মা বাবা পরিবারের সাথে থাকতেন। তখন আপনাদের সাধ আহ্লাদ পূরণ করতে আপনাদের বাবা মায়েরাও নিশ্চয়ই তাদের সাধ্য মত অনেক কিছুই করেছেন। সেটুকু ভেবেই না হয় আমার ছেলের আর্জিটা রাখুন, প্লীজ।" ডক্টর মুখার্জির কথা শুনে আমার মুখে আর কোন কথা যোগাল না যেন। আমি মাথা নিচু করে কিছু একটা বলতে যেতেই পেছনের দরজা দিয়ে আদি ‘মামি মামি’ বলতে বলতে দৌড়ে ঘরে ঢুকল। তাকে ওভাবে ছুটতে দেখে ডক্টর মুখার্জি আর অনুরাধা দু’জনেই প্রায় একসাথে বলে উঠল "আরে আরে, আস্তে। পড়ে যাবে তো।" পেছন পেছন কাজের মেয়েটি ছুটতে ছুটতে এসে বলল, "জোর করে আমার কোল থেকে নেমে ছুটে এসেছে।" আমি নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে দৌড়ে গিয়ে আদিকে ধরে বললাম, "অমন করে ছুটতে নেই আদি সোনা। তুমি ব্যথা পাবে তো।" আদি আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, "তুমি আমাদের ঘরে চল মামি। আমাদের ঘরে গিয়ে আমাকে তুমি চকলেট খাইয়ে দেবে। কী মজা। মা বলেছে তুমি চকলেট খাইয়ে দিলে সে আমায় বকবে না আজ।" আমি আদিকে কোলে নিয়ে আবার আমার চেয়ারে বসতেই আদি আমার গলা জড়িয়ে ধরে বলল, "না না মামি, এখানে নয়, এখানে নয়। আমাদের ঘরে চল। ও বাপি তুমি মামিকে বলনা আমাদের ঘরে যেতে।" আদির কথা শুনে আমি অসহায় ভাবে ডক্টর মুখার্জির দিকে চাইতেই তিনি মিষ্টি করে হেসে বললেন, "মিনুদেবী, এখন আমার ছেলেকে আমিও কন্ট্রোল করতে পারব না। ও, যখন চাইছে, তাহলে একটু কষ্ট করে ওর কথাটা রাখুন না। ভয়ের তো কিছু নেই। এখানে কেউ আপনাকে কোনও রকম অসম্মান করবে না।" আমি তবু কিন্তু কিন্তু করে বললাম, "কিন্তু ডক্টর, ঘরে তো আপনার পরিবারের লোকেরাও আছেন নিশ্চয়ই। এভাবে হঠাৎ হুট করে অজানা অচেনাদের সামনে যাওয়াটা কি সমীচীন হবে?" ডক্টর মুখার্জী একটু রসিকতার সুরে বললেন, "হু, তা অবশ্য মন্দ বলেন নি। তবে আমার ঘরে তো আপাততঃ এই শেফালী আর আদি ছাড়া আছে শুধু আদির মা, মানে আমার মিসেস। ও অবশ্য একটু কড়া ধাঁচের মানুষ। যাকে তাকে নিজেদের ঘরে ঢুকিয়ে নেওয়া পছন্দ করে না। তবে আমার মনে হয়, আদির মুখে সে-ও আপনার কথা শুনেছে বলেই ওকে চকলেট খাবার অনুমতি দিয়েছে। তাই আপনি নিশ্চিন্তে যেতে পারেন। অবশ্য যদি আমার ছেলের অনুরোধটা আপনি রাখতে না চান, তাহলে আর আমার কিছু বলার নেই।" আমি এবার অনুরাধার দিকে চাইতেই ও বলল, "যাও না মিনুদি। আদি যখন এত করে বলছে তখন ওদের ঘরে গিয়েই নাহয় চকলেটটা খাইয়ে এস। আমি বরং ডাক্তার বাবুর সাথে এখানে বসেই একটু গল্প করি। এত বড় একজন ডাক্তারের সাথে বসে আড্ডা দেবার সুযোগ পাওয়া কি চাট্টিখানি কথা? এ দিনটা আমার কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে" বলে আমাকে চোখ টিপে ঈশারা করল। আমি নিরূপায় হয়েই আদিকে কোলে নিয়ে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে চকলেটের প্যাকেটটা হাতে নিতেই কাজের মেয়েটা মিষ্টি করে হেসে এগিয়ে যেতে যেতে বলল, "আসুন দিদি, আমার সাথে আসুন।" পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে কাজের মেয়েটার পেছন পেছন সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় একটা ঘরে ঢুকেই মনে হল সেটা ও বাড়ির ড্রয়িং রুম। খুবই রুচিসম্মত ভাবে সাজানো ঘরটা। কাজের মেয়েটা আমাকে একটা সোফার দিকে ঈশারা করে বলল, "এখানে বসুন দিদি।" আমি আদিকে নিয়ে সোফায় বসতেই আদি আমার কোল থেকে নেমে সোফায় বসে বলল, "জানো মামি। মা আমাকে একদম চকলেট খেতে দেয় না। বলে চকলেট খেলে নাকি দাঁত খারাপ হয়ে যাবে। আজ তুমি আমার জন্য চকলেট এনেছ শুনেই শুধু আমাকে খেতে বলেছে। আচ্ছা মামি, তুমি কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলে বল তো? মা বাবা মামু বিড্ডুমামু সব্বাই তোমাকে কত খুঁজেছে।" আমি চকলেটের প্যাকেটটা খুলে সামনের দিকের কিছুটা অংশ বাইরে বের করে আদির মুখের সামনে তুলে ধরতেই আদি কামড় দিয়ে একটা টুকরো মুখে নিয়েই আমার গলা জড়িয়ে ধরে আমার গালে চুমু খেয়ে বলল, "তুমি আমার মিষ্টি মামি। আমি আর তোমাকে এখান থেকে যেতে দেব না। তুমি এখন থেকে আমাদের বাড়িতেই থাকবে। আমি রাতে তোমার সাথে ঘুমবো।" আমি একটু হেসে বললাম, "মাকে ছেড়ে আমার সাথে ঘুমোবে তুমি? মা রাগ করবে না?" আদি মুখের ভেতর চকলেট চিবোতে চিবোতে বলল, "মা তো খুব খুশী হবে। তোমাকেও তো মা আর মামু কত ভালবাসে। তুমি হারিয়ে গেছ বলে তোমার কথা বলতে বলতে মামু আর মা দু’জনেই তো কাঁদে। কাল রাতেও তো কেঁদেছে।" আদির কথা শুনে আমি আবার অবাক হলাম। কাজের মেয়েটা সোফার পাশেই আমাদের পেছনে দাঁড়িয়েছিল। আমি অবাক হয়ে মেয়েটার মুখের দিকে তাকাতেই আদি সোফা থেকে নেমে বলল, "তুমি বস মামি। আমি মাকে দেখিয়ে আসছি যে তুমি আমায় চকলেট খাইয়ে দিয়েছ" বলেই আমি কিছু বলবার আগেই সে ছুটে পাশের আরেকটা ঘরে ঢুকে গেল। ছোট বাচ্চার খামখেয়ালী ভেবেই আমি একটু দ্বিধান্বিত ভাবে কাজের মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলাম, "আদির মামি কি সত্যি হারিয়ে গেছে?" মেয়েটা বলল, "আমি সেটা ঠিক জানিনে দিদি। আমি এ বাড়িতে আসবার পর তো ওর কোন মামিকে দেখিনি। ওই যে দেয়ালের কোনায় একটা ফটো দেখতে পাচ্ছেন ওই ফটোর মাঝখানের ভদ্রমহিলাকেই আদি মামি বলে। কিন্তু আমি তাকে আগে কখনও দেখিনি। কিন্তু আপনার মুখের সাথে ওই ফটোর ভদ্রমহিলার মুখের খুব মিল আছে। দাদাবাবুর মানিব্যাগেও ওই ভদ্রমহিলার একটা ফটো আছে।" আমি নেহাৎ কৌতূহল বশতঃই সোফা থেকে উঠে দেয়ালে টাঙানো ছবিটার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই আমার সারাটা শরীর যেন থরথর করে কেঁপে উঠল। পাঁচজনের একটা গ্রুপ ফটো সুন্দর আধুনিক ডিজাইনের একটা ফটোফ্রেমে বাঁধানো। কিন্তু ওই পাঁচজনের ছবি দেখতেই আমার হৃৎপিণ্ডটা যেন একলাফে আমার গলার কাছে চলে এল। আমার গলা দিয়ে একটা চাপা চিৎকার বেরিয়ে আসতে চাইছিল যেন। নিজের মুখটা দু’হাতে চেপে ধরতেই আমার মনে হল চারপাশটা যেন কেমন অন্ধকার হয়ে আসছে। আশেপাশের সবকিছু যেন চারদিকে গোল হয়ে ঘুরতে শুরু করেছে। আমার চোখের পাতাদুটো যেন বুজে আসতে চাইছে। অনেক চেষ্টা করেও কিছুতেই যেন আর তাকিয়ে থাকতে পারছিনা। দুর থেকে কে যেন ‘দিদি দিদি’ বলে ডাকছে আমায়। আর কিছু মনে নেই। একসময় আমার মনে হল আমার আশেপাশে অনেক লোকের ভিড়। আমি যেন কোন একটা নরম কোলে মাথা পেতে শুয়ে আছি। আমার গালে কেউ যেন আস্তে আস্তে চাঁটি মারছে। আমি চোখ মেলে চাইতেই দেখি আমার মুখের সামনে অনেক লোকের ভিড়। বিজলীমাসি, শ্যামলীদি, অনুরাধা ছাড়াও আরও বেশ কয়েকটা অচেনা মুখ। আমার কোমরের কাছ থেকে একজন উঠতে উঠতে বলল, "এই তো, সেন্স ফিরে এসেছে। শ্যামলী, তুই তাড়াতাড়ি এক গ্লাস গরম দুধ নিয়ে আয় তো।" সে মুখটার দিকে তাকিয়ে দেখি ডক্টর মুখার্জী। আমার মনে হল গলার ভেতরটা একেবারে শুকিয়ে আছে। কোন কথা বলতে পারছি না। অনেক কষ্টে দু’বার ‘জল জল’ বলতেই শ্যামলীদি আমার ঠোঁটের সাথে একটা গ্লাস চেপে ধরে বলল, "নে মিনু, এই যে জল। খা।" আমি বুঝতে পাচ্ছিলাম কেউ আমাকে তার কোলে শুইয়ে রেখেছে। তেমনিভাবে শুয়ে থেকেই ঢকঢক করে বেশ কিছুটা জল খাবার পর নিজেই মুখটা সরিয়ে নিলাম। এমন সময় দুটো মেয়েলী হাত আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। আমি বুঝতে পারলাম আমি যার কোলে শুয়ে আছি, এ হাতদুটো তারই। কাঁদতে কাঁদতেই সে মহিলা বলতে লাগল, "রুমু, সোনা বোন আমার। কেন তুই আমাদের কাছে ফিরে যাসনি রে? আমরা তো সবাই তখনও বেঁচে ছিলাম।" এমন সময় ডক্টর মুখার্জি বললেন, "আহ ঝুনু। নিজেকে সামলাও। এভাবে তোমরা সবাই মিলে কান্নাকাটি শুরু করলে, কে কাকে সামলাবে বল তো?" ঝুনু নাম শুনেই আমি আরেকবার কেঁপে উঠলাম। মহিলার হাতের বাঁধনের ভেতরে থেকেই আমি অনেক চেষ্টা করে নিজের শরীরটাকে একটু ঘুরিয়ে মুখ ওপরে তুলতেই দেখতে পেলাম ঝুনুদিকে। আমাদের পাশের বাড়ির রমেন কাকু আর সোনা কাকিমার মেয়ে, টুপুর দিদি ঝুনুদি! সাথে সাথে আমি গলা ছেড়ে ‘ঝুনুদি’ বলে চিৎকার করে উঠে তাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরলাম। আর ঝুনুদিও আমাকে দু’হাতে জাপটে ধরে হাউহাউ করে কাঁদতে শুরু করল। কতক্ষণ দু’জন দু’জনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলাম জানিনা। একসময় বিজলীমাসি আমার মুখটা জোর করে টেনে তার দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে বলল, "মিনু, আর কাঁদিস নে বোন। এই দুধটুকু খেয়ে নে। একটু ভাল লাগবে।" আমি বিজলীমাসির মুখের দিকে দেখে অবাক গলায় জিজ্ঞেস করলাম, "মাসি তুমি এখানে?" বিজলীমাসি নিজের চোখের জল মুছতে মুছতে জবাব দিল, "নিজের পরিচয়টা এতদিন আমার কাছে গোপন রেখে তুই আমাকে দিয়ে কত পাপ করিয়েছিস জানিস? আর শোন, এখন থেকে আমাকে আর মাসি বলে ডাকবি না। পারলে আমাকে দিদি বলে ডাকিস। তুই যে আমার নীলু জেঠুর মেয়ে রে, আমার একটা ছোট বোন।" আমি মাসির কথা শুনে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, "কী বলছ তুমি? নীলু জেঠু.... মানে?" বিজলীমাসি আমাকে ধরে ঝুনুদির কোল থেকে টেনে তুলে দুধের গ্লাসটা আমার ঠোঁটে ছুঁইয়ে বলল, "আগে এ দুধটুকু খেয়ে নে। তারপর সব শুনতে পারবি।" আমি দুধের গ্লাসে চুমুক দিতেই পেছন থেকে ডক্টর মুখার্জির গলা শুনতে পেলাম। উনি কাউকে জিজ্ঞেস করছেন, "ওদিকের খবর কি বিদ্যুৎ? সব ঠিক আছে তো?" কোন পুরুষ কণ্ঠ জবাব দিল, "হ্যাঁ শান্তুদা। মোটামুটি ঠিক আছে। কান্না থেমেছে। কিন্তু আপনার আদিবাবুকে সামলানোই কষ্টকর হয়ে উঠেছে। উনি তার মামির কাছে আসবার জন্য খুব ছটফট করছে।" ঝুনুদি এবার বলল, "না বিদ্যুৎ। ওকে এখনই এখানে নিয়ে এস না। আরেকটু সময় থাক।" আমি ঝুনুদির মুখের দিকে কৌতুহলী চোখে চেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, "আদি তোমার ছেলে ঝুনুদি? সত্যি?" ঝুনুদি আমাকে একহাতে তার শরীরের সাথে চেপে ধরে বলল, "হ্যাঁরে রুমু। আদি আমার আর তোর এই ডাক্তার মুখার্জির ছেলে।" আমি সে’কথা শুনে আবার অবাক হয়ে ঘাড় ফিরিয়ে ডক্টর মুখার্জির দিকে একবার চেয়ে ঝুনুদিকে বললাম, "আমায় ছাড়ো ঝুনুদি। জামাইবাবুকে একটা প্রণাম করি।" ডক্টর মুখার্জি দরজার সামনে থেকে জবাব দিলেন, "সে সব পরে দেখা যাবে। তবে ওই জামাইবাবু টামাইবাবু চলবে না। তুমি যদি আমার ছেলের মামি হও, তাহলে আমি সম্পর্কে তোমার নন্দাই হব। আর আজকের যুগে কেউ নন্দাইকে ঠাকুরজামাই বা জামাইবাবু বলে না। ব্যাকডেটেড বলে মনে হয়। শুধু শান্তনুদা বা শান্তুদা বলে ডাকলেই খুশী হব।" আমি ডক্টর মুখার্জির কথা শুনে ভীত চোখে ঝুনুদির মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, "ঝুনুদি, ডক্টর মুখার্জী আমার ট্রিটমেন্ট করেছেন বলে আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ। কিন্তু এ’সব তোমরা কি বলছ গো?" ঝুনুদি আমার মুখটাকে নিজের দু’হাতের মধ্যে ধরে বলল, "কেন রে? আমরা সবাই তো তোকে আগে থেকেই টুপুর সাথে বিয়ে দিতে চাইছিলাম। জেঠু জেঠিমাও তো মনে মনে সেটাই চাইতেন। শুধু কাস্ট নিয়েই যা একটু দ্বিধা ছিল সকলের মনে। কিন্তু সকলের মনের সে দ্বিধাও তো একটা সময় কেটে গিয়েছিল। তারা তো আর কেউ বেঁচে নেই। আর আমার ধারণা, তারা বেঁচে থাকলে আরও অনেক বছর আগেই তোদের বিয়েটা হয়ে যেত। সেই দুর্ঘটনার পর থেকে তোকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না বলেই না এতদিন সেটা সম্ভব হয়নি। এখন আর সেটা হতে বাঁধা কিসের?" আমি ঝুনুদির কথা শুনে শিউড়ে উঠে বললাম, "না না ঝুনুদি, এ তুমি কি বলছ? এ হতে পারে না। কিছুতেই হতে পারে না। তোমরা জানো না। তোমাদের চেনা রুমু সেই দুর্ঘটনার রাতেই মরে গিয়েছে। এখন শুধু বেঁচে আছে এই মিনু। আর গত বারোটা বছর ধরে এই মিনুর ওপর দিয়ে যত ঝড় ঝাপটা বয়ে গেছে, তাতে কোন ভদ্রলোকের স্ত্রী হওয়া তো দুরের কথা, একটা ভদ্রপরিবারের আশ্রিতা হবার যোগ্যতাও তার নেই।" ঝুনুদি আমার মাথায় গালে হাত বোলাতে বোলাতে ছলছল চোখে বলল, "তুইই শুধু তোর মা বাবা বড়দা ছোড়দাকে হারাসনি রুমু। তাদের সবাইকেই আমাদের পরিবারের সকলেও আপনজন বলে ভাবত। আমিও তো তাদের সকলকে হারিয়েছি। তারপর হারালাম নিজের মা বাবাকে। এখন শুধু স্বামী আর ছেলে বাদে নিজের বলতে আর কেউ যদি আমার জীবনে থেকে থাকে, তারা হল তুই আর টুপু। আমাদের ওই দুটো বাড়ির ন’জনের মধ্যে আমরা দু’ভাই বোন ছাড়া শুধু তুই বেঁচে আছিস। ভাইকে আমি বারোটা বছর ধরে কাঁদতে দেখে আসছি। পাগলের মত আমরা দু’ভাই বোন মিলে তোকে খুঁজেছি। কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও তোকে আমরা খুঁজে বের করতে পারিনি। মাস দুয়েক আগেই এই বিদ্যুতের মুখে প্রথম শুনলাম তুই বেঁচে আছিস। তোর খবরটা পাবার পর তোর পরিণতির কথা শুনে আমরা দু’ভাইবোন মিলে শুধু কেঁদেই যাচ্ছি। তোর কথা শুনে আমরা দু’জনেই ছটফট করছিলাম তোকে দেখতে। আজ এতদিন এত বছর বাদে ভগবান আমাদের যখন দয়া করে একসাথে মিলিয়ে দিয়েছেন, তখন আয় না বোন আমরা তিনজন মিলে আবার নতুন করে একটা পৃথিবী বানাই। তুই তো জানিস না। আমার বিয়ের পর বৌভাতের দিন মা বাবার অ্যাক্সিডেন্ট হল। খবর পেয়ে শান্তুর বাড়ির সকলে যখন আমাকে আর ভাইকে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছল, তখন মা আর নেই। বাবার প্রাণটা তখনও ছিল। বাবা আমার আর টুপুর একটা একটা হাত ধরে বলেছিলেন যে তিনি জেঠু জেঠিমাকে কথা দিয়েছিলেন যে তোর বড়দার সাথে আমার বিয়ে দেবেন, আর তোকে আমাদের ঘরের বৌ করে আনবেন। কিন্তু ভগবান তো সবাইকে আগেই তার কাছে টেনে নিয়েছিলেন। তবে তুই যে বেঁচে ছিলি এ’কথা বাবা মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন। তাই আমাদের দু’জনকে বলেছিলেন, যে করেই হোক, আমরা যেন তোকে খুঁজে বের করি। আর তুই যে পরিস্থিতিতে যে ভাবেই থাকিস, টুপু যেন তোকে বিয়ে করে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে বাবার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করে। তাহলেই তার আত্মা শান্তি পাবে। এতগুলো বছর ধরে আমরা দু’ভাই বোন যে সে স্বপ্নটাই বুকে ধরে রেখেছি রে। এতগুলো বছর কেটে যাবার পর যখন আমরা প্রায় হাল ছেড়ে দিচ্ছিলাম, তখনই বিদ্যুৎ একটা আশার খবর নিয়ে এসেছিল। তাই তো আজকের এই সুদিনটা আমাদের জীবনে এসেছে। ভগবান আবার আমাদের তিনজনকে একসঙ্গে করে দিয়েছেন আজ। ভগবানও নিশ্চয়ই চান যে বাবার শেষ ইচ্ছেটা আমরা রক্ষা করি। তুই কেন বাদ সাধছিস এতে, বল তো বোন?" আমি ঝুনুদির কথা শুনতে শুনতে একনাগাড়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেই যাচ্ছিলাম। ঝুনুদিরও দুটো চোখ থেকে অবিরত অশ্রুধারা বেরোচ্ছিল। তার কথা শেষ হতেই আমি ঝুনুদির থেকে একটু সরে যাবার চেষ্টা করতে করতে বললাম, "না গো ঝুনুদি। সেটা যে হবার নয় গো। আমি যে একেবারে শেষ হয়ে গেছি। আমার সারা গায়ে এমন নোংরা লেগেছে যে, কোন সুস্থ মানুষের কাছাকাছিও আমি যেতে পারব না। আমি তোমার দুটি পায়ে পড়ি ঝুনুদি। আমাকে তোমরা ক্ষমা করে দাও। আমার এ নোংরা শরীর নিয়ে তোমার কথা মেনে নিলে কাকু কাকিমার আত্মাও যে কষ্ট পাবে গো।" ঝুনুদি আবার আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, "আমি তোকে আর আমাদের ছেড়ে চলে যেতে দেব না রে রুমু। তোর সব খবর আমরা সবাই জানি। তোর শরীরের যে কলঙ্কের কথা বলছিস, আমরা সে’সব কিছুই মেনে নিয়েছি। কারন আমরা জানি, এ’সবের জন্য তোর নিজের কোন দোষই নেই। দোষ যদি কারো হয়ে থাকে, তা করেছিল কেবল ওই গজানন। আর সে পাপের শাস্তি সে পেয়েছে। ওই দলের আর যারা জীবিত ধরা পড়েছে, তারাও ফাঁসিতে ঝুলবে। তাই এখন থেকে তুই আর মিনু নোস। তুই আবার আগের সেই রুমু হয়ে উঠবি। আর সেটা হতে তোকে সাহায্য করব আমি, ভাই আর আমরা সবাই।" এ’সব কথার ফাঁকে ডক্টর মুখার্জি যে কখন আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন আমি সেটা বুঝতেই পারিনি। ঝুনুদির কথা শেষ হতেই তিনি বললেন, "ঝুনু, রুমুকে ধরে পাশের গেস্টরুমে নিয়ে যাও। ওর আগে একটু বিশ্রাম নেওয়া খুব দরকার।" এ’কথা শুনেই ঝুনুদি, অনুরাধা আর শ্যামলীদি আমাকে ধরাধরি করে পাশের একটা ঘরে নিয়ে গেল। সেখানে আমাকে তারা বিছানায় শুইয়ে দিতেই ডক্টর মুখার্জী আমার হাতে একটা ইঞ্জেকশন দিলেন। ইঞ্জেকশনটা পুষ করতে করতেই ডক্টর মুখার্জী বললেন, "দু’ঘণ্টা যাবার আগে কেউ আর এ ঘরে আসবে না। রাত আটটায় আমি এসে ওকে একবার পরীক্ষা করে দেখব। তারপর বাকি কথা হবে। তোমরা ততক্ষণে সবাই মিলে ও’দিকের অন্যান্য কাজকর্ম গুলো দেখ।" আর শুনতে পেলাম না আমি। ঘুমের কোলে ঢলে পড়লাম। একটা সময় আমার ডানহাতে চাপ অনুভব করতেই আমার ঘুম ভেঙে গেল। চোখ মেলে দেখি ডক্টর মুখার্জী আমার প্রেসার মেপে দেখছেন একটা যন্ত্রের সাহায্যে। আর সেই সাথে আমার পালসও পরীক্ষা করছেন। আমাকে চোখ মেলে চাইতে দেখেই উনি মিষ্টি করে হেসে জিজ্ঞেস করলেন, "ঘুমটা কেমন হয়েছে রুমু? আমার শালাবাবুর স্বপ্ন দেখনি তো ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে?" আমি তার কথার সরাসরি জবাব না দিয়ে বললাম, "ইশ কত রাত হয়ে গেল ছিঃ ছিঃ। আর কত ভাবেই না আপনাদের বিরক্ত করছি আমি। তা ডক্টর আমার সঙ্গে যে রাধা এসেছিল, সে কি চলে গেছে?" ডক্টর আমার বাহুতে জড়ানো কাপড়টা খুলতে খুলতে বলল, "ঠিক আছে। এখন তোমার কণ্ডিশন অনেকটা স্ট্যাবল। আমি অনুরাধাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। তবে তুমি কিন্তু এখনই উঠে বসবে না। শুয়ে শুয়েই তার সাথে কথা বলবে।" আমি হা হা করে উঠে বললাম, "ওমা, না না। এ আপনি কী বলছেন? আমাকে বাড়ি ফিরতে হবে তো। আপনি বুঝতে পাচ্ছেন না। কত রাত হয়ে গেল। ড্রাইভারটা বোধহয় এখনও গাড়ি নিয়ে বাইরে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।"
Parent