মহানগরের আলেয়া_Written By pinuram [এগারো - যুদ্ধের দামামা (০১ - ০৩)]
মহানগরের আলেয়া
Written By pinuram
এগারো
যুদ্ধের দামামা (#০১)
রাত প্রায় তিনটে বাজে তখন, যখন দানা নয়নার বাড়ি ছেড়ে বের হয়। জানুয়ারি মাসের শেষের ঠাণ্ডায় নির্জন রাস্তায় কুকুরের দেখা পর্যন্ত পাওয়া যায় না। রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে একটা সিগারেট জ্বালায়। কিছুটা অনুশোচনা ভর করে আসে দানার মাথায়। সত্যি কি আবার দানা এক পশু হয়ে গেল। কি করে মহুয়া আর রুহির সামনে এই দেহ নিয়ে দাঁড়াবে। নিজেকে বুঝাতে চেষ্টা করে, নয়না চেয়েছিল এই ধর্ষকাম তাই চরম ধর্ষকামে মেতে উঠেছিল। বাপ্পা নস্করের বিরুদ্ধাচরণ হয়ত করত কিন্তু ওকে খুন করার চিন্তা কোনোদিন দানার মাথায় আসেনি। কিন্তু তাহলে দানা কেন এক নৃশংস জানোয়ারে পরিনত হয়ে গেল। হ্যাঁ, দানার বুকে আজও একটু হলেও ইন্দ্রাণীর প্রতি ভালোবাসা কোথাও একটা রয়ে গেছে। তাই নয়নার মুখে যখন ইন্দ্রাণীর নাম শোনে তখন দানা আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারেনি। মহেন্দ্র বাবুর শিক্ষা দীক্ষা, মহুয়ার ভালোবাসা, রুহির আধো আধো কথা সব উপেক্ষা করে দানা এক পশু হয়ে উঠেছিল।
হু হু করে ঠাণ্ডা বাতাস ওকে ভেতর থেকে কাঁপিয়ে দেয়। মদ খেয়ে আর নয়নার শরীরের সাথে নৃশংস ভাবে খেলা করে ওর শরীর গরম হয়ে গেছে। নয়নার মতন চূড়ান্ত লাস্যময়ী অভিনেত্রীর সাথে ভীষণ ধর্ষকাম ক্রীড়া করার পরে দানার পাশবিক চিত্ত অতীব ভালো লাগায় ভরে যায়। তবে দানা মনে মনে বুঝতে পারে, নয়না যেমন ধূর্ত ভয়ঙ্কর সর্পিণী সে নিশ্চয় দানার ওপরে প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করবেই করবে। ওর হাতে আর বেশি সময় নেই। সকালের আগেই সঙ্গীতাকে একটা নিরাপদ জায়গায় লুকিয়ে ফেলতে হবে, মহুয়ার আর ইন্দ্রাণীর বাড়ির সামনে পাহারা বসাতে হবে। মহুয়ার সাথে ওর সম্পর্কের ব্যাপারে কেউই জানে না, তাই নয়না সেই ব্যাপারে আঁচ করতে পারেনি। তবে এইবারে নয়ন সতর্ক হয়ে যাবে আর দানার প্রতিটি পদক্ষেপে ওর নজর থাকবে। বারে বারে ইন্দ্রাণীকেই সবাই আঘাত দেওয়ার চেষ্টা করে। ইন্দ্রাণী কি মন্দিরের ঘন্টা, যে কেউ আসতে যেতে একবার বাজিয়ে চলে যাবে। দানা কি করবে, এর পরের পদক্ষেপ কি হবে, কার কাছে গেলে সাহায্য পাওয়া যাবে, ইত্যাদি ভাবতে শুরু করে দেয়। সব থেকে আগে সঙ্গীতাকে এক নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়া দরকার। রমলা এই খবর জানতে পারলে সঙ্গীতাকে হয়ত প্রানে মেরে ফেলেবে।
এত রাতে এই নির্জন এলাকায় ট্যাক্সি পাওয়া খুব মুশকিল। দানা, কেষ্টকে ফোন করে। বেশ কিছুক্ষণ ফোন বেজে যাওয়ার পরে ঘুম ঘুম চোখে কেষ্ট ফোন উঠায়। দানা ওকে এই এলাকার ঠিকানা দিয়ে ট্যাক্সি আনতে নির্দেশ দেয়। কেষ্ট প্রথমে কিছুই বুঝতে পারে না। অনেকদিন পরে আসন্ন সন্তান সম্ভবা স্ত্রীকে বেশ জড়িয়ে ধরে, লেপের তলায় ঘুমিয়ে ছিল। কিন্তু দানার জলদ গম্ভীর কণ্ঠের নির্দেশ উপেক্ষা করতে পারে না। বেশ কিছুক্ষণ পরে ট্যাক্সি নিয়ে দানার দেওয়া ঠিকানায় চলে আসে। দানা, ট্যাক্সিতে উঠে কেষ্টকে সঙ্গীতার ঠিকানা দিয়ে ওইখানে নিয়ে যেতে নির্দেশ দেয়। পথে যেতে যেতে দানা বিশেষ কিছু কেষ্টকে জানায় না, শুধু এইটুকু জানায় যে খুব বিপদে পড়েছে। দানার রক্ত চক্ষু আর হিমশীতল কণ্ঠ স্বর শুনে, কেষ্ট বিশেষ কিছু জিজ্ঞেস করতে সাহস পায় না। পথে যেতে যেতে দানা, শঙ্কর আর রমিজ কে ফোন করে, সেই সাথে ফারহান আর মদনাকেও ফোন করে সঙ্গীতার ঠিকানায় ডেকে নেয়। সবাইকে এক কথা জানায় যে একটা মেয়ে খুব বিপদে, কিন্তু কি বিপদ জানতে চাইলে কাউকে কিছু পরিষ্কার করে না জানিয়ে বলে দেখা হলে সব কথা খুলে বলবে।
রাত চারটে নাগাদ দানা সঙ্গীতার বাড়িতে পৌঁছায়। সঙ্গীতার বাড়ির লোক তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে দানা বুক ভরে এক শ্বাস নেয়। সঙ্গীতাকে সেই এক মাস আগে নয়নার কবল থেকে বাঁচানোর পরে ওদের মধ্যে বিশেষ দেখা সাক্ষাৎ হয়নি। একবার হয়েছিল, সঙ্গীতা নিজের প্রেমিক মৈনাককে নিয়ে ওকে একটা বড় রেস্টুরেন্টে খাইয়েছিল আর সেই সাথে মৈনাক আর সঙ্গীতা ওর হাত ধরে ধন্যবাদ জানিয়েছিল। সেদিন সঙ্গীতা খুব কেঁদেছিল, দানা না থাকলে সেদিন হয়ত নয়না আর সুমিতা ওকে আধমরা করে রাস্তায় ফেলে দিত।
বেশ কয়েকবার কলিং বেল বাজানোর পরে সঙ্গীতার বাবা এসে দরজা খুলে অবাক হয়ে দানাকে জিজ্ঞেস করে, "কি ব্যাপার, এতরাতে কি হয়েছে?"
দানা, কেষ্টকে নিয়ে সঙ্গীতার বাড়িতে ঢুকে পড়ে, ওর বাবাকে জিজ্ঞেস করে, "সঙ্গীতা কোথায়?"
এত রাতে একজন লোক বাড়িতে এসে মেয়ের কথা জিজ্ঞেস করছে দেখে সঙ্গীতার বাবা ভয় পেয়ে যান। কম্পিত ভয়ার্ত কণ্ঠে দানাকে জিজ্ঞেস করে, "কি হয়েছে?"
দানা, সঙ্গীতার বাবাকে আশ্বস্ত করে বলে, "কাকা, সঙ্গীতার খুব বিপদ। এখুনি সঙ্গীতাকে কোন নিরাপদ স্থানে লুকিয়ে ফেলতে হবে।"
কথাবার্তা শুনে সঙ্গীতার মা, নিজের ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে আসেন, দানা আর কেষ্টকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে যান। কিছুক্ষণ ওদের দিকে তাকিয়ে ডুকরে কেঁদে ফেলেন সঙ্গীতার মা। সঙ্গীতার মাকে ওই ভাবে কাঁদতে দেখে, দানা অবাক হয়ে যায়। সঙ্গীতার বাবা দানাকে আক্ষেপের কণ্ঠে বলে, "সাত দিন আগে, সঙ্গীতার এক্সিডেন্ট হয়েছে। ওর বন্ধু মৈনাক ওই এক্সিডেন্টে মারা গেছে। সঙ্গীতা খুব মুষড়ে পড়ে গেছে, মেয়েটা একদম ভেঙ্গে পড়েছে দানা।"
সঙ্গীতার মা কাঁদতে কাঁদতে ওকে বলেন, "এই আসছে বৈশাখে মৈনাক আর সঙ্গীতার বিয়ের কথাবার্তা চলছিল। কিন্তু মেয়েটার অদৃষ্ট কোন সুখ ওর কপালে নেই মনে হয়।"
সেই শুনে দানার চোখ ফেটে জল বেড়িয়ে আসে। সঙ্গীতাকে আগেই সরিয়ে ফেলা উচিত ছিল। ওর এই দেরির জন্য আজকে মৈনাক এই পৃথিবীতে নেই। রাগে ও ক্ষোভে দানার মনে হয় নিজের মাথার চুল ছেঁড়ে। ধুপ করে একটা চেয়ারে বসে সঙ্গীতার বাবাকে ওই এক্সিডেন্টের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে, যে একদিন বিকেলে ওরা দুইজনে সঙ্গীতার স্কুটিতে করে বেড়াতে বেড়িয়েছিল। সেই সময়ে একটা ট্রাক এসে স্কুটির পেছনে ধাক্কা মারে। মৈনাক পেছনে বসে ছিল আর সঙ্গীতা স্কুটি চালাচ্ছিল, মৈনাক স্কুটি থেকে পড়ে যেতেই ট্রাকের পেছনের চাকা মৈনাককে রাস্তার সাথে পিষে দিয়ে চলে যায়। মৈনাক তৎক্ষণাৎ প্রান হারায় আর সঙ্গীতা বেশ কিছু দূরে ছিটকে পড়ে আর ওর পা ভেঙ্গে যায়। এক্সিডেন্ট কেস বানিয়ে পুলিস তদন্ত শুরু করেছে, তবে এখন পর্যন্ত কেউ ধরা পড়েনি অথবা সেই ট্রাকের কোন হদিস পাওয়া যায়নি।
দানা চোখ বুজে একবার চিন্তা করার চেষ্টা করে, এই কাজ নয়নার নয়। নয়না এত বড় ভুল পদক্ষেপ নেবে না। নয়না ভালো ভাবেই জানে, সঙ্গীতা মারা গেলে বাপ্পা নস্করের সাথে সাথে নিজেও বদনাম হয়ে যাবে। এতদিন পর্যন্ত দানা, নয়নার বিশ্বাস ভাজন ব্যাক্তি ছিল। সঙ্গীতার বিরুদ্ধে যদি কোন চক্রান্ত করত তাহলে দানা জানতে পারত। কে মারতে পারে সঙ্গীতাকে? সঙ্গীতা মারা গেলে কারা সব থেকে বেশি লাভবান হবে? বিমান চন্দ কি সঙ্গীতাকে মারতে চায়, কিন্তু কেন, তাতে বিমান চন্দের কি লাভ? হয়ত ওর ভয়টাই সত্য বলে প্রমানিত হয়েছে, হয়ত রমলা বিশ্বাস সঙ্গীতাকে মারতে চেষ্টা করেছে। বুকের মাঝে দুমদুম করে যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে, মাথা ভোঁ ভোঁ করে, চিন্তা শক্তি লোপ পায় কিন্তু এখুনি চিন্তা শক্তি লোপ পেলে হবে কি করে? ওকে যে আজ রাতের মধ্যেই সব কাজ সারতে হবে।
দানা সঙ্গীতার বাবার হাত ধরে বলে, "কাকা, সঙ্গীতাকে একটা নিরাপদ স্থানে নিয়ে যেতে চাই।"
ওর মা চোখের জল মুছে জিজ্ঞেস করে, "কোথায় নিয়ে যেতে চাও?"
দানা বুক ভরে শ্বাস নিয়ে বলে, "নিরাপদ স্থানেই নিয়ে যাবো। ওর মাথায় আসন্ন বিপদ। যাদের সাথে আমার যুদ্ধ তারা সবাই খুব শক্তিশালী আর ক্ষমতাশালী ব্যাক্তি। যদি পারা যায় তাহলে কয়েক মাসের জন্য দেশ ছেড়ে অন্য চলে গেলে আরো ভালো হয়।"
ওর বাবা খানিকক্ষণ চিন্তা করার পরে দানাকে বলে, "আমার এক দুর সম্পর্কের আত্মীয় ফ্রান্সে থাকে। আমার শালীর মেয়ে ওইখানে গেছে পড়াশুনা করতে। দেখি যদি ওকে ওইখানে পাঠাতে পারি। কিন্তু এখন কোথায় নিয়ে যেতে চাও?"
সঙ্গীতার বাবাকে মহেন্দ্র বাবুর কথা জানায় দানা। ইতিমধ্যে রমিজ ভাই আর শঙ্কর, জনা দশেক ছেলে নিয়ে সঙ্গীতার বাড়িতে পৌঁছে যায়। দানা সবাইকে সংক্ষেপে ঘটনা জানিয়ে দেয়। সেই শুনে সবাই ভাবনায় পড়ে যায়, বুঝতে বাকি থাকেনা যে দানা একটা বোলতার চাকে ঢিল ছুঁড়েছে। কিন্তু দানা জানে কোন বোলতা এখুনি ওকে কামরাতে আসবে না কারন দানা সরাসরি কোন বোলতাকে আক্রমন করেনি। তবে একটা সংশয় আছে, অভিনেত্রী নয়না বোস।
দানা, সঙ্গীতার মা'কে অনুরোধ করে এক বার সঙ্গীতাকে দেখতে চায়। সঙ্গীতার মা ওকে সঙ্গীতার ঘরের মধ্যে নিয়ে যায়। এই কয়দিনে সঙ্গীতার হাসি হাসি সুন্দর দেহ শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে, চোয়াল ঢুকে গেছে, কণ্ঠির হাড় বেড়িয়ে গেছে, দুই চোখের কোনে কালিমা পড়ে গেছে। সঙ্গীতার ওই শুকনো দেহ দেখে দানার মাথায় রক্ত চড়ে যায়। ভীষণ ক্রোধাগ্নি দাউদাউ করে মাথার মধ্যে জ্বলে ওঠে। অচেতন অবস্থায় সঙ্গীতা বিছানার ওপরে লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে। সঙ্গীতার মা মেয়ের মাথার কাছে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে ওকে ঘুম থেকে জাগিয়ে দেয়। ঘুম ঘুম চোখ খুলে এতরাতে সামনে মাকে আর দানাকে দেখে কিছু বুঝতে পারে না। দানা ওর পাশে এসে ওর হাতের ওপরে হাত রাখতেই সঙ্গীতা ভেঙ্গে পড়ে। ওর চোখের সামনে মৈনাকের মৃত্যু দৃশ্য ছেয়ে যায়।
ডুকরে কাঁদতে কাঁদতে দানাকে বলে, "বাঁচাতে পারলাম না গো, আমি কিছুতেই ওকে বাঁচাতে পারলাম না।"
সেই কান্না দেখে দানার চোখ ফেটে জল বেড়িয়ে আসার যোগাড় হয়, কিন্তু মন শক্ত করে সঙ্গীতাকে বলে, "তোমাকে নিয়ে এখুনি আমাদের বেড়িয়ে পড়তে হবে। পারলে কাকু কাকিমা আমাদের সাথে আসুক।"
কিছুক্ষণের মধ্যেই সঙ্গীতা আর ওর বাবা মাকে নিয়ে দানা আর বাকিরা, মহেন্দ্র বাবুর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। শঙ্কর সব কথা আগে থেকেই মহেন্দ্র বাবুকে জানিয়ে রেখেছিল। মহেন্দ্র বাবুর বাড়ি পৌঁছানর পরে দানা, মহেন্দ্র বাবুকে সবিস্তারে সব কিছু খুলে বলে। তবে ওর সাথে নয়নার গোপন সম্পর্ক আর রাতের ধর্ষকামের কথা লুকিয়ে যায়। মহেন্দ্র বাবু সব কিছু শুনে ভীষণ ক্রোধান্বিত হয়ে ওঠেন। দানাকে বলেন এখুনি পুলিসের কাছে যেতে। মহেন্দ্র বাবুর চেনা পরিচিত, সাত্যকি চ্যাটার্জি, পুলিসের ডেপুটি কমিশনারের কথা বলে দানাকে। কিন্তু দানা এখুনি পুলিসের কাছে যেতে চায় না, কারন এই জালে অনেক মানুষ জড়িয়ে, একজন কে আঘাত করলে অন্য জনে প্রতিশোধ নিতে তেড়ে উঠবে। আর সেই আগুন, ইন্দ্রাণী, মহুয়া আর রুহিকে পুড়িয়ে ছারখার করে দেবে। দানার মাথায় বুদ্ধি খেলে যায়। ভালো মানুষ সেজে এক এক করে সবাইকে জালে ফাঁসাতে হবে, তারপরে সময় হলে জাল গুটিয়ে নেবে। মহেন্দ্র বাবু জানতে চান, কি করতে চায় দানা, ওর মাথায় কি পরিকল্পনা চলছে। দানার সংক্ষেপে শুধু মাত্র জানায় যে এবারে ওকে মাথা ঠাণ্ডা রেখে পা ফেলতে হবে। এখন ওর মাথা খালি তবে কিছুদিনের মধ্যেই একটা সুচতুর পরিকল্পনা তৈরি করবে আর সবাইকে জানিয়ে দেবে।
দানা, ফারহানের হাত ধরে অনুরোধ করে যাতে এই খবর কোন মতে বাপ্পা নস্করের কানে না ওঠে। তবে সকালে ওর বাড়ি গিয়ে পিস্তল ফেরত দিয়ে বাপ্পা নস্করকে জানিয়ে দেবে যে আর নয়নার গাড়ি চালাতে চায় না। রমিজের কাছে দুটো পিস্তল চায়। সঙ্গে সঙ্গে রমিজ ওকে দুটো পিস্তল আর বেশ কয়েকটা ম্যাগাজিন ধরিয়ে দেয়। ফারহান আর বাকিরা সবাই সমস্বরে ওকে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দেয়। বিশেষ করে রমিজ বলে ওর জন্য প্রান দিতে প্রস্তুত। সেই সাথে বস্তি থেকে আসা, মদনা, মনা পিন্টু বলাই সবাই সমস্বরে ওকে বলে দানার জন্য সবকিছু দিতে প্রস্তুত। দানা ওদের বস্তির হাল ফিরিয়ে দিয়েছে, ওই এলাকার মুকুট হীন রাজা।
সঙ্গীতার কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার সময়ে ওকে বলে, "তুমি আর কাকা কাকিমা এইখানে থাকো। এইখানে তোমাদের চুলের ডগা কেউ ছুঁতে পারবে না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফ্রান্সে যাওয়ার জন্য চেষ্টা কর।" একটু থেমে ওকে জিজ্ঞেস করে, "তোমার তদন্তের সব কিছু কি রমলার হাতে তুলে দিয়েছিলে?"
সঙ্গীতা মাথা নাড়িয়ে জানায়, "না না, ওই তথ্য প্রমানের দুটো কপি আছে। যেটা আমি রমলাকে দিয়েছিলাম তাতে শুধু বাপ্পা নস্করের ব্যাপারে আর ওর সাথে নয়নার গোপন সম্পর্কের ব্যাপারে প্রমান ছিল। বাকি সব কিছু একটা দ্বিতীয় কপি করে একটা ছোট চিপে রাখা আর সেটা আমার মাসতুতো বোন অপরাজিতার কাছে। আমার বোন, অপরাজিতা ফ্রান্সে আর্কিটেকচার নিয়ে পড়াশুনা করতে গেছে। ওকে বলা আছে, যদি আমার কোনোদিন কিছু হয় তাহলে ওই চিপ যেন পুলিসের হাতে তুলে দেয়।"
সব শুনে দানা ওকে বলে, "আচ্ছা বুঝলাম, তুমি ফ্রান্সে গিয়ে ওই চিপ আমাকে পাঠানোর ব্যাবস্থা কর।"
সঙ্গীতা মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দেয়, ফ্রান্সে গিয়ে সর্ব প্রথম সেই ব্যাবস্থা করবে।
বলাই আর শক্তিকে, ইন্দ্রাণীর বাড়ির ওপরে নজর রাখতে নির্দেশ দেয়, দানা। ওদের বুঝিয়ে বলে যে ইন্দ্রাণী আর ওর পরিবারের পেছনে যেন ছায়ার মতন লেগে থাকে। কখন যদি কিছু সন্দেহ জনক দেখে তাহলে সঙ্গে সঙ্গে যেন দানাকে খবর দেয়। ফারহানকে বলে আগের মতন বাপ্পা নস্করের কাছে ফিরে যেতে আর সকালের দিকে দানা নিজেই বাপ্পা নস্করের কাছে চলে যাবে। বাকি সবাইকে তখন কার মতন বাড়ি ফিরে যেতে অনুরোধ করে আর বলে রাতের বেলা মদনার চায়ের দোকানে দেখা করবে। বলাই আর শক্তি একটা গাড়ি নিয়ে ইন্দ্রাণীর বাড়ির উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে যায়।
যুদ্ধের দামামা (#০২)
মনা আর পিন্টুকে নিয়ে দানা, মহুয়ার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। মহুয়ার বাড়ির দিকে যেতে যেতে বারেবারে রুহির হাসিহাসি মুখ খানি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ওর বাড়িতে গেলেই ছোট ছোট পায়ে দৌড়াতে দৌড়াতে এসে ওর কোলের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়বে। পিতাকে মনে নেই রুহির, তবে বারেবারে এই দানার বুকের মাঝে পিতার শীতল স্নেহ পরশ খুঁজে বেড়ায়। দানা সেটা অনুধাবন করে তাই কচি শিশুটাকে আঁকড়ে ধরে থাকে যতক্ষণ মহুয়ার সাথে থাকে।
সকাল ন’টা নাগাদ মহুয়ার বাড়িতে মনা আর পিন্টুকে নিয়ে পৌঁছে যায়।
এত সকালে দানাকে ঠিক এই ভাবে দেখতে পাবে সেটা মহুয়া আশা করেনি। ওকে দেখে ভারী খুশি, কিন্তু পেছনে মনা আর পিন্টুকে দেখে একটু চিন্তিত হয়ে যায়।
মহুয়া দানাকে প্রশ্ন করে, "তোমার কি হয়েছে? তোমাকে এমন ঝোড়ো কাকের মতন কেন দেখাচ্ছে?"
দানা উঁকি মেরে একবার শোয়ার ঘরের দিকে তাকায়। কচি শিশু রুহি, লেপের তলায় তখন গুটিসুটি মেরে অঘোরে ঘুমিয়ে। মহুয়া জানে, দানা রুহিকে খুব ভালোবাসে, তাই ওর পাশ ঘেঁসে দাঁড়িয়ে বলে, "মেয়েকে এত কি দেখছ? জাগিয়ে দেব নাকি?"
দানা মাথা নাড়িয়ে হেসে বলে, "না না, শুয়ে থাক। পরে জাগিও।" মহুয়ার হাত ধরে শোয়ার ঘরে নিয়ে যায়। বিছানায় বসিয়ে ওকে বলে, "তোমার সাথে একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করার ছিল আমার।"
উৎসুক মহুয়া ওকে জিজ্ঞেস করে, "কি ব্যাপার কি হয়েছে? তোমাকে দেখেই মনে হচ্ছে তুমি যুদ্ধ করে এসেছ। কি হয়েছে সত্যি করে বল।"
মহুয়ার উদ্বেগ মাখা কণ্ঠ আর কোমল হাতের ছোঁয়ায় দানার অন্তর কেঁপে ওঠে। খুব ভালোবাসে মহুয়াকে তাই ওকে মিথ্যে বলা যাবে না। এতদিন মহুয়া জানে যে নয়নার সাথে শুধু মাত্র গাড়ির চালক আর মালিকের সম্পর্ক। মহুয়া ওদের ভেতরের গোপন শারীরিক মিলনের ব্যাপারে কিছুই জানে না। নয়নার সাথে যে বাপ্পা নস্করের গোপন সম্পর্ক আর সেই সাথে বিমান চন্দের সাথেও যে গোপন সম্পর্ক সেটা দানার মুখে অনেক দিন আগেই মহুয়া শুনেছে। এমনকি সঙ্গীতাকে কি ভাবে নয়নার কবল থেকে বাঁচিয়ে এনেছে সেটাও মহুয়া জানে। আর সব জানে বলেই ওর খুব গর্ব যে শেষ পর্যন্ত একজন প্রকৃত পুরুষকে ভালোবাসে। কিন্তু মহুয়া যদি জানতে পারে দানার আর নয়নার গোপন শারীরিক সম্পর্ক তাহলে কি মহুয়া সেটা মেনে নেবে? নয়নার সাথে দানার সাক্ষাৎ ওদের ভালোবাসার পরেই হয়েছে, তাও ওকে ছেড়ে কেন দানা ওই ছলনাময়ী নারীর কবলে পড়ল? নিরুত্তর দানা অনেকক্ষণ মহুয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে বাক্য সংগঠিত করার আপ্রান চেষ্টা করে।
মহুয়া ওর চোখের ভাষা পড়ে ফেলে জিজ্ঞেস করে, "তুমি কি রাতের বেলা নয়নার সাথে কিছু করেছ?"
দানার ঠোঁট কেঁপে ওঠে, হৃদপিণ্ডের ধুকপুকানি স্থির হয়ে যায়। ওর সামনে মাথা নিচু করে বসে আলতো মাথা নাড়ায়, "হ্যাঁ।"
পাশেই রুহি শুয়ে তাই, চাপা কণ্ঠে দানাকে জিজ্ঞেস করে, "কি করেছ ওর সাথে? আর এমন ঝোড় কাকের মতন তোমাকে দেখাচ্ছে কেন?"
দানা ওর হাতখানি শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে, "দয়া করে আমাকে ভুল বুঝোনা মহুয়া।"
মহুয়ার বুকের রক্ত চঞ্চল হয়ে ওঠে। উৎসুক ছলছল চোখে দানার দিকে তাকিয়ে থাকে উত্তরের আশায়। দানা কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলতে শুরু করে, রাতের ঘটনা। কি ভাবে নয়না, বাপ্পা নস্করকে খুন পরিকল্পনা করে। কি ভাবে বারে বারে ইন্দ্রাণীর নাম নিয়ে ওকে শাসানোর এক আভাস দেয়। কি ভাবে প্রচন্ড কামুকী নয়না ওকে ধর্ষকামে প্ররোচিত করে, আর শেষ পর্যন্ত দানা মদের নেশায় আর ভীষণ ক্রোধে নয়নাকে বেঁধে চরম ধর্ষকামে মেতে ওঠে। এই সব কথা বলার সময়ে ভীষণ অনুতাপে দানা একটি বারের জন্য মহুয়ার দিকে তাকাতে পারেনি।
দানার মুখ থেকে সব ঘটনা শুনতে শুনতে, আতঙ্কে মহুয়ার শরীর ভীষণ ঠাণ্ডা হয়ে যায়। মনে মনে নিজেকে ধিক্কার জানায়, শেষ পর্যন্ত দানা? যে ওকে ওই নরপিশাচ শ্বশুরের হাত থেকে বাঁচিয়ে নিয়ে এসেছিল সেই মানুষ কি ভাবে এক ভীষণ কাম পিশাচ দানবে পরিনত হতে পারে? তার মানে ভবিষ্যতে মহুয়াকে ওই ভাবে ধর্ষণ করতে পিছ পা হবে না। কিন্তু দানার চোখে জল দেখে মহুয়ার আতঙ্ক ভেঙ্গে ক্রোধে শরীর জ্বলে ওঠে। ওর হাতের থেকে হাত ছাড়িয়ে ঠাসিয়ে দানার গালে একটা চড় কষিয়ে দেয়। দানা এই চড়ের প্রতীক্ষায় ছিল, জানত যে মহুয়া এই সব শোনার পরে ওকে একটা চড় কষাবে।
দানার হাত ধরে টেনে বিছানা থেকে উঠিয়ে চাপা গলায় ওকে বলে, "বেড়িয়ে যাও আমার বাড়ি থেকে। তোমার ছায়াও যেন আমার রুহির ধারে কাছে আসে না।"
ভীষণ বেদনায় দানা কুঁকড়ে যায়, চোখ ফেটে জল বেড়িয়ে আসে। মহুয়ার হাত ধরতে চেষ্টা করে কিন্তু মহুয়া নিজের হাত ছাড়িয়ে পিছিয়ে যায়। দানা ওর সামনে হাত জোর করে দাঁড়িয়ে কাতর কণ্ঠে বলে, "আমি জানি আমি একটা পশুর মতন কাজ করেছি কিন্তু নয়না নিজেই চেয়েছিল এটা। আর ওকে শাস্তি দেওয়া উচিত ছিল।"
মহুয়া ঝাঁঝিয়ে ওঠে, "তাহলে ওই ধূর্ত কামুকী নয়নার সাথে তোমার তফাৎ কোথায়? একটা কুকুর তোমাকে যদি কামড়ায় তাহলে তুমি সেই কুকুরকেও কামড়াবে? মহেন্দ্র বাবু কি এই শিক্ষা তোমাকে দিয়েছিলেন? ভবিষ্যতে আমি যদি কখন কিছু ভুল করে ফেলি তাহলে আমাকেও তুমি বেঁধে ধর্ষণ করবে, তাই না?"
ওই কথা শুনে দানার বুক ফেটে যায়, আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। ঋজু দেহ ঝড়ের প্রকোপে এক ছিন্ন লতার মতন মহুয়ার পায়ের কাছে নেতিয়ে পড়ে। অনুতপ্ত গলায় মহুয়ার সামনে মাথা নিচু করে ধরা গলায় বলে, "না মহুয়া, এই রুহির....."
রুহির নাম শুনতেই আরো একটা চড় দানার গালে কষিয়ে বলে, "একদম ওই মুখে আমার মেয়ের নাম নেবে না। কত আশা করে মেয়েটা রোজ সকালে ঘুম থেকে ওঠে যে বিকেলে অথবা রাতের বেলা ওর দানা ওর জন্য চকোলেট নিয়ে আসবে আর তুমি কি না শেষ পর্যন্ত একটা নৃশংস পশুর মতন আচরন করলে? ছিঃ দানা, ছিঃ। তোমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে আমার ঘৃণা বোধ করছে দানা। এখুনি তুমি আমার বাড়ি ছেড়ে বেড়িয়ে যাও।"
মহুয়ার চোখের জল বাঁধ মানতে নারাজ, কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বিছানায় বসে ঘুমন্ত রুহিকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ওঠে, "আমার অদৃষ্ট, ভগবান আমার কপালে প্রকৃত পুরুষ কোনোদিন জুটিয়ে দেয় নি। স্কুলে অন্য ছেলেরা আমাকে দেখে টিটকিরি মারত সেই দেখে আমার বাবা আমার পড়াশুনা ছাড়িয়ে দিল, আর শেষ পর্যন্ত ইতর লোকেশের হাতে আমাকে বেচে দিল। জীবনে স্বামীর ভালোবাসা কি বুঝতে পারিনি। রাজেশ মারা যাওয়ার পরে, শ্বশুর আমার শরীর নিয়ে যথেচ্ছ ভাবে নিজের কামুক ইতর কামনা বাসনা চরিতার্থ করল। শেষ পর্যন্ত তোমাকে পেয়ে ভেবেছিলাম জীবনটা শান্তিতে কাটবে কিন্তু শেষ পর্যন্ত তুমি?"
এর উত্তর দানার কাছে নেই, দানা সত্যি পাপী। প্রথমে ইন্দ্রাণীর পাপী তারপরে মহুয়ার কাছে পাপী। এই পাপের আর ক্ষমা নেই। এইবারে কোথায় যাবে দানা? কি করবে? কিন্তু এইবারে যুদ্ধে নেমেছে, সুতরাং ওদের কাছ থেকে সরে থাকলেও দূরে থাকতে পারবে না কিছুতেই। আহত নাগিনী নয়না নিশ্চয় সুযোগ খুঁজবে ইন্দ্রাণীকে আঘাত করার। দানা নত মস্তকে পাপের বোঝা কাঁধে নিয়ে মহুয়ার বাড়ি ছেড়ে বেড়িয়ে আসে।
ওকে ওই ভাবে নতমস্তকে বাড়ি ছেড়ে বেড়িয়ে আসতে দেখে মনা আর পিন্টু কারন জিজ্ঞেস করে। দানা জানায় কিছু কারনে ওর আর মহুয়ার মধ্যে ঝগড়া হয়েছে তাই একটু ভারাক্রান্ত কিন্তু মনা আর পিন্টু যেন এই বাড়ি পাহাড় দেয়। ক্ষণিকের জন্যেও যেন মহুয়া আর রুহিকে চোখের আড়াল না করে। মনা আর পিন্টু জানিয়ে দেয়, যতক্ষণ ওদের শরীরে জীবন থাকবে ততক্ষণ কেউ "মহুয়া ম্যাডামের" আর "রুহি সোনার" চুলের ডগা ছুঁতে পারবে না।
দানা অনেকক্ষণ মহুয়ার বাড়ির নিচে দাঁড়িয়ে থাকে। বুকের মধ্যে ঝড় বয়ে যায়, কিছুতেই সেই ঝড় শান্ত করতে পারে না। কেন নয়নার ছলনার কবলে পড়েছিল? কেন নয়নার সাথে সঙ্গমে লিপ্ত হয়েছিল, এতকিছু যদি দানা না করত তাহলে এই পর্যায়ে কখন পৌঁছাত না। মহুয়ার কথা মেনে নয়নার কাজে যোগ না দিয়ে যদি সেই সময়ে দানা একটা ব্যাবসা করত তাহলে ওর জীবনের খাত অন্যদিকে বয়ে যেত। একটা সুখী জীবন যাপন করতে পারত। একটা সুন্দরী স্ত্রী, একটু ফুটফুটে কচি শিশু ওর হতে পারত। দানা যে নিজের জীবন নিজে হাতে বারেবারে খন্ডন করেছে। এইবারে দানাকে সব ভুল অঙ্ক আবার করে কষতে হবে। তবে ইন্দ্রাণীকে অথবা মহুয়াকে হয়ত আর ফিরে পাবে না। ইন্দ্রাণী কেমন আছে? অনেকদিন ওর কোন খবর নেই। যদিও বলাই আর শক্তিকে ওর বাড়ির ওপরে নজর রাখতে পাঠিয়েছে তাও এক বার মন মাঝি চঞ্চল হয়ে ওঠে ইন্দ্রাণীকে দেখার জন্য।
এতক্ষণে নয়না নিশ্চয় বাড়িতে ফিরে গেছে। কি করছে নয়না? গত রাতে ভীষণ উত্তেজক ভাবে নয়নার কোমল দেহ পল্লব দুমড়ে মুচড়ে খামচে চাপড়ে নর খাদক অসুরের মতন ধর্ষণ করে গেছে। নয়না ওর সাথীদের সাথে এতক্ষণে নিশ্চয় দানার বিরুদ্ধে চক্রান্ত শুরু করে দিয়েছে। কি পদক্ষেপ নিতে পারে নয়না। বাপ্পা নস্করের কাছে যাবে না বিমান চন্দের কাছে যাবে। বাপ্পা নস্করের কাছে গেলে দানার হাতে ওর বিরুদ্ধে মোক্ষম অস্ত্র তৈরি আছে। ওর মোবাইলে বিমান আর নয়নার একত্রের ছবি। বিমানের পরনে শুধু মাত্র একটা তোয়ালে আর নয়নার পরনেও একটা তোয়ালে। একটা নির্জন বাড়ির মধ্যে দুই পূর্ণ বয়স্ক নারী পুরুষ তোয়ালে গায়ে দিয়ে হুতুম পেঁচার গল্প অন্তত করে না সেটা সবাই জানে।
এইবারে বাপ্পা নস্করের কাছে যাওয়া উচিত। ওকে জানাতে হবে যে দানা আর নয়নার গাড়ি চালাতে চায় না। কিন্তু যদি বাপ্পা নস্কর ওকে জিজ্ঞেস করে যে দানা এরপরে কি করবে তাহলে দানা কি উত্তর দেবে? না না, দানা বলবে ও কোন একটা ব্যাবসা করতে চায়। কিন্তু টাকা কোথায়? নয়নাকে শাসিয়ে ব্যাবসার টাকা আদায় করবে।
কিছুক্ষণ পরে দানা, বাপ্পা নস্করের বাড়িতে পৌঁছে যায়। এত সকালে দানাকে দেখে বাপ্পা নস্কর আশ্চর্য চকিত হয়ে ওকে আসার কারন জিজ্ঞেস করে।
দানা ওকে বলে, "আপনার সাথে একটু ব্যাক্তিগত আলোচনা করার আছে।" বাপ্পা নস্কর উৎসুক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। দানা ওকে বলে, "আমি আর নয়নার গাড়ি চালাতে চাই না।"
বাপ্পা নস্কর অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, "কেন রে কি হয়েছে? ভালোই ত চলছিল।"
দানা মাথা চুলকে, ঠোঁট মেকি হাসি দিয়ে বলে, "না মানে নিজের ব্যাবসা করার ইচ্ছে আছে তাই আর গাড়ি চালাতে চাই না।"
বাপ্পা ভুরু কুঁচকে ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পরে জিজ্ঞেস করে, "সেটা বেশ কিন্তু আমার খবর দবরের কি হবে তাহলে?"
দানা মিচকি হেসে উত্তরে বলে, "তিন মাসে নয়না কোথায় গেছে কার সাথে গেছে সব আমি আপনাকে জানিয়েছি। আমার মনে হয় এই ছাড়া নয়না আর কোথাও যায় না।"
বাপ্পা নস্কর ওর কথা বিশ্বাস করে নেয়। দানা সেই বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে বলে, "আমি ব্যাবসা করলে আপনি আমাকে সাহায্য করবেন?"
পয়সা পিশাচ বাপ্পা কিঞ্চিত হেসে ওকে বলে, "আচ্ছা দেখা যাবে। তুই কি করতে চাস সেটা আগে বল।"
দানা মাথা চুলকে খানিকক্ষন ভেবে বলে, "দেখি কিছু এখন ঠিক করিনি তবে নয়নার গাড়ি আমি আজ থেকে আর চালাবো না।" এই বলে বাপ্পার সামনে পকেট থেকে পিস্তল, সাইলেন্সার আর ম্যাগাজিন গুলো রেখে দেয়।
ঠিক সেই সময়ে বাপ্পার কাছে একটা ফোন আসে। ফোনের কথাবার্তা শুনে দানার কান খাড়া হয়ে যায় সেই সাথে বাপ্পা বারেবারে দানার দিকে তাকিয়ে দেখে। বাপ্পার কথোপকথন দানার কানে ভেসে আসে, "হ্যাঁ কি হয়েছে?..... হ্যাঁ একটু আগেই আমার কাছে এসেছিল। হ্যাঁ নিজেই বলেছে..... কি হয়েছে ঠিক বলো তো?..... তাই নাকি আচ্ছা ওকে আমি জিজ্ঞেস করে নেব..... "
ফোন ছেড়েই বাপ্পা নস্কর দানাকে গুরু গম্ভির কণ্ঠে প্রশ্ন করে, "কি রে কাল রাতে নয়নার সাথে কি হয়েছিল?"
দানা ঠিক এটাই ভয় করেছিল। ফোনের ওইপাশে তাহলে নয়না ছিল। বুক দুরুদুরু করে ওঠে, ক্রোধে শরীর জ্বলে ওঠে। ওর শেষ সম্বল বিমানের সাথে নয়নার ছবি গুলো তাহলে এই বারে বাপ্পাকে দেখাতেই হবে।
বাপ্পা টেবিল থেকে পিস্তল হাতে নিয়ে একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে, দানাকে বলে, "আরে বাবা, নয়না অভিনেত্রী মানুষ। একটু খানি ঝগড়া হয়েছে বলে কি কাজ ছেড়ে দিবি নাকি? যা যা নয়নার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিস আর ওর গাড়ি চালতে শুরু কর।"
দানার চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। এ আবার কোন নতুন খেলায় নেমেছে নয়না। বাপ্পার কাছে দানার নামে শুধু মাত্র ঝগড়ার নালিশ করে গেল কেন? নয়নার চাল ঠিক বোধগম্য হল না। নয়না ফোন করে শুধু মাত্র দানাকে সরাতে বলেছে আর কিছু জানায় নি।
দানা কিছুতেই আর নয়নার গাড়ি চালাবে না তাই বাপ্পাকে বিনয়ের সহিত বলে, "না বাপ্পাদা এবারে নিজের ব্যাবসা, আর গাড়ি নয়।"
বাপ্পা খানিক হেসে ওর পিঠ চাপড়ে বলে, "আবার একটা তোর মতন ভালো বিশ্বাসী ড্রাইভার কোথায় পাই বলত? আচ্ছা এইবারে চলে যাচ্ছিস কিন্তু মনে রাখিস আমার কথা।"
কি কথা? দানা উৎসুক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকাতেই বাপ্পা হেসে বলে, "নয় মাস পরে কিন্তু নির্বাচন। তোর এলাকার সব ভোট আমার চাই।" তারপরে গলা নামিয়ে বলে, "অরুনকান্তি বাবুকে একটু বলে কয়ে দেখিস, মাঝে মাঝে দলে এলে ভালো লাগে আর কি।"
দানা মনে মনে হেসে ফেলে, একবার তোমাকে বাগে পাই তাহলে তোমার সব চর্বি গলিয়ে দেব আমি। মাথায় দুলিয়ে স্বস্তির শ্বাস ফেলে বাপ্পা নস্করের বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসে। কিন্তু মনের মধ্যে হাজার প্রশ্ন ভিড় করে আসে। কেন নয়না ওর বিরুদ্ধে বাপ্পা নস্করের কাছে কোন নালিশ করল না। হয়ত বিমানের কাছে ওর নালিশ করবে। তবে এখন ওর সাথে বিমানের দেখা হয়নি। দানা একা নয় ওর পেছনে প্রচুর লোকবল রয়েছে। ঠাণ্ডা মাথায় এইবারে কাজ সারতে হবে।
যুদ্ধের দামামা (#০৩)
বের হওয়ার সময়ে ফারহানের সাথে দেখা হয়ে যায়। ফারহানকে একপাশে টেনে ওকে বাপ্পা নস্করের ওপরে কড়া নজর রাখতে বলে। ফারহান হেসে জানিয়ে দেয়, অনেক আগে থেকেই সেই কাজ করার কথা ভেবে রেখেছে। বাপ্পা নস্কর সংক্রান্ত সব জরুরি খবর দানার কাছে পৌঁছে যাবে। গাড়ির পেছনে বসা লোকেরা সাধারণত ড্রাইভারকে বিশেষ পাত্তা দেয় না। ফোনে অথবা পাশের লোকের সাথে গাড়ির পেছনের সিটে বসে অনেক গোপন কথাবার্তা সারে এই সব লোকেরা। ফারহান আগে এই সব কথায় বিশেষ কান দিত না কোনোদিন কিন্তু দানার পরিকল্পনা অনুযায়ী এরপর থেকে কান পেতে রাখবে বলে কথা দেয় আর সুযোগ পেলে মোবাইলে সেই কথা টেপ করে নিতে চেষ্টা করবে।
বাপ্পা নস্করের বাড়ি থেকে বেড়িয়ে কোথায় যাবে ঠিক করতে পারে না। সেই পুরানো কালী পাড়ার বস্তির নিজের গুমটি, সেই পুরানো আশ্রয়। তবে পুরানো হলেও দানা এখন ওই এলাকার মুকুট হীন রাজা, এলাকার অনেক লোকেই দানাকে চেনে। যেতে আসতে দেখা হলে কুশল জিজ্ঞাসাবাদ করে, ছোটরা সম্মান করে। সেইসব দেখে দানার বেশ ভালো লাগে। বস্তিতে ঢুকেই বুড়ো দুলালের সাথে একবার দেখা করে যায়। বুড়ো দুলালের বাড়ি একদম পাকা করে দিয়েছে, ডাক্তার হাসপাতালে নিয়মিত দেখায়। শরীর স্বাস্থ্য ভালোই আছে। তারপরে বরুনের বাড়িতে ঢুঁ মারে, বরুনের গুমটির হাল ফিরিয়ে দিয়েছে, বাড়িতে এলেই সুনিতা বৌদি ওকে না খাইয়ে ছাড়ে না। দেবু আর বস্তিতে ফিরে আসেনি, তবে দানার হাত দিয়ে মাঝে মাঝে বাবা মায়ের জন্য টাকা পাঠায়। দানাও নিজে থেকে কিছু কিছু দিয়ে বুড়ো বুড়িকে সাহায্য করে।
নিজের গুমটি খুলে চুপচাপ বিছানার ওপরে বসে থাকে। পরবর্তী পদক্ষেপ কি নেবে সেটা কিছুতেই ভেবে পায় না। তবে কঙ্কনা আর নাসরিনের ঘরে ঢুকে সামনা সামনি খুন করবে দানা। এইসবের শুরু ওই কঙ্কনা আর নাসরিন, ওদের জন্যেই দানা আজকে এই গভীর খাদে গড়িয়ে পড়েছে। ওর জীবনে কঙ্কনা না আসলে ওর ভালোবাসা কোনোদিন ওকে ছেড়ে যেত না। চিত্ত বড়ই চঞ্চল হয়ে ওঠে, গুমটিতে একা বসে থাকতে একদম ভালো লাগে না। নিজেকে বড় অসহায় বলে মনে হয়। কঙ্কনা আর নাসরিনের বাড়ির ঠিকানা জানে না, ওদের ছবি পর্যন্ত নিজের মোবাইলে কোনোদিন তুলে রাখেনি। অবশ্য যাদের সাথে সহবাস করেছে তাদের কারুর ছবি দানা কোনোদিন তোলেনি কারন বেশ্যা বৃত্তি পেশায় সেটা একদম নিয়ম বিরুদ্ধ কাজ। নয়নার বাড়ির ওপরে কড়া নজর রাখতে হবে, সুমিতা আর সমুদ্রের ওপরেও কড়া নজর রাখতে হবে। বিমান চন্দ, বাপ্পা নস্কর, নয়না বোস, রমলা বিশ্বাস, কঙ্কনা দেবনাথ, নাসরিন আখতার, সিমোন খৈতান, মোহন খৈতান সবাই এক একটা রিং কিন্তু এই রিং গুলো জুড়ে একটা শেকল আর কিছুতেই বানাতে পারছে না। মাথার মধ্যে সব কিছু গুলিয়ে যেতে শুরু করে দেয়। কিন্তু সঙ্গীতার প্রেমিক, মৈনাককে কে খুন করতে পারে সেটা কিছুতেই ধরতে পারছে না। কঙ্কনা আর নাসরিন কেন দানাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল সেটা বুঝে উঠতে এখন পারেনি। রমলার দুর্বল নাড়ি কোথায় সেটা জানতে হবে। দিনে দিনে প্রশ্নের পাহাড় ওর মাথার ওপরে চেপে বসেছে।
সন্ধ্যের পরে শঙ্কর রমিজ আরো অনেকে মদনার দোকানে পৌঁছে যায়। এক কোনায় জটলা পাকিয়ে বসে সারাদিনের খবরাখবর আর পরবর্তী পরিকল্পনা করতে শুরু করে। মনা আর পিন্টুর কাছে মহুয়ার কথা জানতে চায়।
পিন্টু মাথা চুলকিয়ে হেসে ফেলে, "মহুয়া ম্যাডাম সারাদিন বাড়িতেই ছিলেন। বিকেলে কাজের মেয়ের সাথে একবার বাজারে বেরিয়েছিলেন তারপরে রুহির সাথে সামনের পার্কে নিয়ে গেছিলেন। আমরাও পেছন পেছন আড়াল করে ম্যাডামকে অনুসরন করছিলাম কিন্তু ম্যাডামের নজর এড়াতে পারলাম না। ধরা পরে গেলাম ওনার কাছে।" দানা ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে, পিন্টু মিচকি হেসে, "ম্যাডাম তারপরে বাড়িতে ডেকে আমাদের চা, মিষ্টি খাইয়ে তবে ছাড়লেন।"
দানা মনে মনে হেসে ফেলে, বড় মিষ্টি নরম এই মেয়েটা।
বলাইয়ের কাছে ইন্দ্রাণীর ব্যাপারে জানতে চাইলে বলাই জানায়, "ম্যাডাম সকাল বেলা বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যান। বিকেলে ফিরে আসেন। একটা স্কুলে মনে হয় চাকরি করেন। বাড়িতে একজন ভদ্রলোক ছিলেন, তবে কোন ছেলে মেয়েকে দেখলাম না। বিকেলে ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা বাড়িতে পড়াশুনা করতে আসে। এই ব্যাস আর সন্দেহজনক কিছুই চোখে পড়ল না আমার।"
নাসির আর আকরামকে, নয়না আর সমুদ্রের ওপরে নজর রাখতে নির্দেশ দেয়। তখন কার মতন আলোচনা সেরে সবাইকে বাড়ি পাঠিয়ে বলে পরেরদিন যথারীতি এই এক জায়গায় ওদের আলোচনা সভা বসবে। নতুন কোন খবর পেলে ফোনেই যেন দানাকে জানিয়ে দেওয়া হয়। সঙ্গীতাকে দেখাশুনা করার জন্য শঙ্কর আর রমিজকে অনুরোধ করে। শঙ্কর আর রমিজ জানিয়ে দেয় একবার যখন ওরা মহেন্দ্র বাবুর কাছে চলে গেছে তখন সাক্ষাৎ যমদূত না এলে ওদের গায়ে কেউ আঁচড় কাটতে পারবে না।
রাতের বেলা সুনিতা বৌদির হাতের রান্না খেয়ে, অনেকক্ষণ বরুনের সাথে চুটিয়ে আড্ডা মেরে নিজের গুমটিতে ফিরে আসে। নরম বিছানা বড় কণ্টকময় বলে মনে হয়। সিগারেট জ্বালিয়ে শুয়ে শুয়ে চিন্তা করতে শুরু করে দেয়। ইন্দ্রাণীর বাড়িতে ওই নতুন ভদ্রলোক কে? দানাকে ছাড়া পরে ইন্দ্রাণী কি অন্য কারুর প্রেমে পড়েছে? হয়তো বা হতেও পারে। তবে শেষ যেদিন দেখা হয়েছিল সেদিন ইন্দ্রাণী ওকে জানিয়েছিল যে রাতের ওই বেশ্যা বৃত্তি ছেড়ে দিয়ে সুস্থ কর্ম জীবন পালন করবে আর সেটাই বর্তমানে করছে। শুধু মাত্র দানাই ভেসে গেছে। ইন্দ্রাণীর সাথে একটি বার দেখা করার জন্য মন চঞ্চল হয়ে ওঠে। ওর হৃদয় দ্বিবিভক্ত হয়ে যায়, ইন্দ্রাণীর প্রতি পুরানো প্রেম ফের একবার জেগে ওঠে, কিন্তু মহুয়াকে মন থেকে কিছুতেই মুছে ফেলতে পারে না। রুহি নিশ্চয় এতক্ষণ জেগে জেগে ওর অপেক্ষা করে ঘুমিয়ে পড়েছে। আর হয়ত রুহির সাথে দেখা হবে না ওর।
"টুং টাং টুং টাং" মোবাইল বেজে উঠল। এতরাতে শুধু মাত্র মহুয়া ছাড়া আর কেউ ওকে ফোন করতে পারে না। মোবাইল উঠিয়ে দেখে ওর ধারনা সঠিক।
মহুয়া ওইপাশ থেকে শীতল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, "সারা দিনে তোমার খাওয়া দাওয়া হয়েছে?"
ওই মিষ্টি শীতল কণ্ঠ স্বর শুনেই দানার পরান ডাক ছেড়ে ওঠে। সারাদিনের ক্লেদ ক্লান্তি এক নিমেষে উবে যায়। শরীরে এক নতুন শক্তি ভর করে আসে। কণ্ঠে উৎফুল্ল, বুকের মধ্যে রক্তের চাঞ্চল্য বেড়ে ওঠে। মাথা চুলকে মৃদু হেসে বলে, "হ্যাঁ মানে একটু খেয়েছি।"
মহুয়া শান্ত কণ্ঠে ওকে জিজ্ঞেস করে, "সারা দিন কি করলে?"
দানা উত্তরে সবিস্তারে সব কিছু জানায়।
সব কিছু শোনার পরে মহুয়া ওকে বলে, "আমার কথা দয়া করে একটু মন দিয়ে শোন।"
দানা চুপ করে থাকে। মহুয়া ওকে বলে, "তোমাকে মাথা গরম করলে একদম চলবে না। নয়না যদি বাপ্পা নস্করকে খুন করার পরিকল্পনা করতে পারে তার অর্থ নয়না অতি ধুরন্ধর মহিলা। এর থেকে তোমাকে খুব সাবধানে থাকতে হবে। তবে নয়নাকে সম্মুখ সমরে তুমি কোনোদিন হারাতে পারবে না। তোমাকে একটা সুচতুর পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে।"
অন্য পাশে দানা মাথা দোলায়। মহুয়া ওকে বলে, "তোমাকে আগে নিজেকে দাঁড় করাতে হবে যাতে তুমি ওদের সমকক্ষ হতে পারো। তোমার কাছে লোকবলের খামতি নেই। ফারহান, মহেন্দ্রবাবু, শঙ্করদা, রমিজ ভাই, মনা পিন্টু মদনা সবাই তোমার সাথে। সেই সাথে তোমার দরকার টাকার। (বেশ কিছুক্ষণের জন্য থেমে যায় মহুয়া) তোমার টাকার দরকার, সেই টাকা আমি দেব।"
দানার চোখ জোড়া ছলছল করে ওঠে। এতকিছু ঘটে যাওয়ার পরেও এই নারী ওকে সাহায্য করতে প্রস্তুত। ওকে দূরে ঠেলে দেয়নি। দানার ঠোঁট জোড়া কেঁপে ওঠে। কিছু বলতে চায় কিন্তু মহুয়া ওকে থামিয়ে দিয়ে বলে, "আগে আমার কথা মন দিয়ে শোনো। শক্তিশালী প্রতিপত্তিশালী ব্যাক্তি না হলে ওদের দুর্গে আঘাত হানা দুঃসাধ্য। কোন একটা বড় সড় কোন ব্যাবসা করো।"
এইবারে দানাকে ওর কাছ থেকে সাহায্য নিতেই হবে, না হলে ওই ক্ষমতাশালীদের দুর্গে আঘাত হানতে পারবে না। যাদের বিরুদ্ধে লড়াই তারা কেউ অনেক বড়লোক, কেউ বিত্তশালী শিল্পপতি, কেউ রাজনৈতিক দলের নেতা, কেউ সংবাদ মাধ্যমে রয়েছে, কেউ অভিনয় জগতের নামকরা ব্যাক্তি। দানা মাথা নাড়ায় আর চুপচাপ "হ্যাঁ হ্যাঁ..... বুঝেছি বুঝেছি....." বলতে বলতে ওর কথা শুনে যায়। দানার এই নীচ ব্যাবহারের পরেও এই নারী ওকে সাহায্য করতে প্রস্তুত। এই মেয়েটা সত্যি ওকে ভালোবাসে না হলে এতরাতে ফোন করে কথা বলত না। দানার মন ছটফট করে ওঠে মহুয়াকে জড়িয়ে ধরার জন্য।
দানা ধরা গলায় মহুয়াকে জিজ্ঞেস করে, "রুহি ঘুমিয়ে পড়েছে নাকি?"
অন্য পাশে মহুয়া চোখের কোল মুছে মৃদু হেসে বলে, "হ্যাঁ অনেক আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে। আচ্ছা শোনো, তুমি কি ইন্দ্রাণীদির সাথে দেখা করেছ?"
দানা মাথা নাড়ায়, "না এখন দেখা করিনি। কি ভাবে করব ভেবে পাচ্ছি না।"
মহুয়া ওকে বলে, "যত তাড়াতাড়ি পারো একবার দেখা করে এস। তবে....." একটু থেমে যায়, গলার স্বর খাদে নেমে যায়, "আমি তোমাকে ভীষণ..... সাবধানে থেকো, জিত।"
"জিত" এই নামে কেউ ওকে কোনোদিন ডাকেনি। সবাই ওকে দানা বলেই ডেকে গেছে। মায়ের পরে কেউ ভালোবেসে ওকে কোন নাম দেয়নি। এই প্রথম মহুয়ার মুখে নিজের নতুন নামকরনে দানা উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। ওর সাথে আরো কথা বলার জন্য মন মাঝি চঞ্চল হয়ে ওঠে। লাফিয়ে উঠে কিছু বলতে যাওয়ার আগেই মহুয়া ফোন কেটে দেয়। মহুয়ার মন একটা ফুলের চেয়েও নরম আর নিষ্পাপ নিষ্কলঙ্ক ওর ভালোবাসা। অনেকদিন থেকেই ইচ্ছে ছিল ওকে ভালোবেসে "পাপড়ি" বলে ডাকবে কিন্তু সেই সম্বোধন করার আগেই সব কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে গেল।
হঠাৎ কি বলতে গিয়ে থেমে গেল মহুয়ার। নিশ্চয় মহুয়া ভাবছে একবার যদি দানা ইন্দ্রাণীর কাছে যায় তাহলে নিজের প্রথম প্রেম ফিরে পেয়ে মহুয়াকে ভুলে যাবে। নিশ্চয় এই জন্যেই ভারাক্রান্ত হয়ে চুপ করে গেছে। ইন্দ্রাণীর সামনে গেলে দানার মানসিক অবস্থা কি হবে সেটা দানা নিজেও জানে না। ওর হৃদয় যে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। দানা মহুয়াকে তৎক্ষণাৎ ফোন করে, কিন্তু মহুয়া আর ওর ফোন উঠায় না। ফোন বারেবারে বেজে বেজে থেমে যায়, দানার মন ভারী হয়ে যায়। একপাশে দাঁড়িয়ে ইন্দ্রাণী অন্যপাশে দাঁড়িয়ে মহুয়া। ঠিক কার কাছে ফিরে যাবে কিছুতেই ঠিক করতে পারে না দানা। সারা রাত বিছানায় বিনিদ্র রজনী কাটিয়ে দেয়।
সকালে গুমটি থেকে বের হতেই সাজসাজ রব। মেয়েদের জন্য স্নানের জায়গা তৈরি করে দিয়েছিল দানা। ওকে দেখেই মেয়েরা সরে দাঁড়ায়। যেন দানা নয় এই রাজ্যের রাজার প্রবেশ হয়েছে। পুরো বস্তির এহেন আচরনে দানা বেশ বিবৃত বোধ করে, এতটা সন্মানের জন্য দানা প্রস্তুতি নেয়নি। নিজের পাপ বোধ কম করার জন্যেই কালী পাড়ার বস্তি আর আশেপাশের এলাকার উন্নয়নের জন্য টাকা খরচ করেছিল দানা। কোনদিন এত বড় হতে চায়নি, শুধু একটু ভালোবাসা চেয়েছিল, আর সেটা বারেবারে নিজের ভুল পদক্ষেপের জন্যেই খুইয়ে এসেছে। বালতি মগ নিয়ে, বাকি পুরুষের সাথে ওই রাস্তার ধারের করপোরেশানের কলের তলায় বসে স্নান সেরে ফেলে। অধীর বাবুর ট্যাক্সি চালানো নেই, নয়নার গাড়ি চালানো নেই তবে ওর মন বড় অশান্ত। পাশে যে মহুয়াও নেই, ওর মিষ্টি হাসির দেখা নেই, রুহির কোমল হাতের পরশ নেই।
তিনদিন কেটে যায়, মহুয়া কিছুতেই ওর ফোন উঠায় না। মনা আর পিন্টুর মাধ্যমেও মহুয়াকে ধরা যায় না। ওদের ফোনে ফোন করলেও কাজের অছিলায় এড়িয়ে যায়। দানার মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে, রুহি আর মহুয়ার কাছে যাওয়ার জন্য ছটফট করে ওঠে সেই সাথে ইন্দ্রাণীর সাথে দেখা করার ইচ্ছেটাও প্রবল ভাবে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে।
নয়নার খবর জানতে চাইলে নাসির ওকে জানায়, গত তিন দিনে নয়না বাড়ি থেকে বের হয়নি। তবে একটা নতুন ড্রাইভার ইতিমধ্যে নিযুক্ত করা হয়েছে। সমুদ্র আর সুমিতা এক প্রকার ওর বাড়িতেই আজকাল থাকে। মাঝে মাঝেই লোক জন আসে অসুস্থ নয়নার সাথে দেখা করতে। ইতিমধ্যে খবরের কাগজে খবর ছেপে গেছে, অভিনেত্রী নয়না বোস, বাথরুমে পড়ে গিয়ে অসুস্থ হয়ে বাড়িতে বসে। বাপ রে, এই অভিনেতা অভিনেত্রীদের নিজস্ব একান্ত কোন জীবন নেই, না কি এটা একটা চাল। বড়লোকেরা সব সময়ে খবরের কাগজের শিরোনামে থাকতে ভালোবাসে। দানা ওদের দুর্বল নাড়ি ধরে ফেলে, কিন্তু সংবাদ মাধ্যম ওই ধনী ক্ষমতাশালীদের হাতের পুতুল।
ইন্দ্রাণীর বাড়ির খবর জানতে চাইলে, শক্তি আর বলাই জানায়, ওই ভদ্রলোক কে একদিন শুধু মাত্র দেখা গিয়েছিল তারপরে আর দেখা যায়নি। নিত্যদিনের মতন ইন্দ্রাণী স্কুল করে, বিকেলে ছোট ছেলে মেয়েদের পড়ায়।
ফারহান খবর দেয় যে বাপ্পা নস্কর, অসুস্থ নয়নার ব্যাপারে বেশ চিন্তিত। তবে বেশি চিন্তিত আসন্ন নির্বাচনের জন্য। নয় মাস পরে এই রাজ্যে নির্বাচন, দলের কাছে এইবারে অত টাকা নেই, নিজের ভাঁড়ার প্রায় শুন্য। ওর দৌরাত্মে নতুন কোন প্রোমোটার এই এলাকায় কাজে হাত লাগাতে চাইছে না। পুরানো প্রোমোটারদের কাছে হুমকি দিয়ে আর কত টাকা আদায় করতে পারে। বাপ্পার ভীষণ দৌরাত্মের ফলে এই এলাকায় বহু আবাসন স্থান অর্ধ নির্মিত হয়ে পরে আছে, সেই প্রোমোটারদের কাছে টাকা চাইতে পারছে না আর। এলাকায় বেশ কিছু বড় বড় কোম্পানির হোটেল আর আবাসন এখন পর্যন্ত শুধু মাত্র ভিত তৈরি হয়েই থেমে গেছে।
দানার মাথায় বুদ্ধি খেলে যায়, ওকে এই প্রোমোটারি ব্যাবসায় নামতে হবে। মহেন্দ্র বাবুর কাছে থাকাকালীন প্রচুর বিল্ডার প্রোমোটারদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করেছে। যদিও ওই সব বিল্ডার প্রোমোটার অন্য এলাকার মানুষ কিন্তু দানাকে বুদ্ধি দিয়ে কিছুটা অন্তত সাহায্য করতে পারে। বাপ্পার কাছ থেকে সাহায্য পেয়ে যাবে, বাপ্পাকে টাকা দিয়ে শান্ত রাখা যাবে আর টাকা আয় করার একটা বেশ ভালো পথ পাওয়া যাবে। পারলে ওই অর্ধ নির্মিত আবাসন গুলো মালিকদের কাছ থেকে কিনে নিয়ে কাজ শুরু করতে পারবে। বাপ্পাও খুশি, দানাও খুশি, সেই মালিক গুলো খুশি, যারা এতদিনে টাকা দিয়ে ওই আবাসনের ফ্লাট কিনেছিল তারা সময় মতন না হলেও কয়েক মাস পরে ফ্লাট পেয়ে খুশি হয়ে যাবে। তবে এর জন্য সর্ব প্রথম মহুয়ার সাথে কথা বলা দরকার, আর মহুয়া যে ওর ফোন উঠাচ্ছে না.....
********** পর্ব এগারো সমাপ্ত **********