কাজল নদী_Written By Tumi_je_amar [ষষ্ঠ পরিচ্ছদ – সবাইতো সুখী হতে চায় (চ্যাপ্টার ১৫ - চ্যাপ্টার ২০)]
কাজল নদী
Written By Tumi_je_amar
ষষ্ঠ পরিচ্ছদ – সবাইতো সুখী হতে চায়
(#১৫)
প্রায় ছয় মাস কেটে যায়। সংসার যেমন চলছিল সেইরকমই চলে। মানসীর এখন বাড়িতে প্রায় কোন কাজই নেই। ব্রততী অনেক প্রতিকুল অবস্থাতেও মানিয়ে নেবার চেষ্টা করে। দীপ্তি আর লেখা দাদার নতুন বৌকে কিছুতেই কাছে টানতে পারে না। যদিও ওরা ব্রততীর থেকে ছোট, তবু এই সংসারে এতদিন ওরাই সব কিছু দেখত। সেখানে ব্রততী কিছু করতে গেলে ওরা সব সময় কিছু না কিছু ভুল ধরে। শেষ পর্যন্ত ঠিক হয়েছে সপ্তাহে একদিন ব্রততী সব রান্না করবে। সেদিন দীপ্তি আর লেখার ছুটি। বাকি দিন গুলো ব্রততী ঘর পরিস্কার করার তদারকি করবে। মানসী খুব শান্তিতে আছে। সারাদিন স্কুল আর পার্লার নিয়ে কেটে যায়। এখন সপ্তাহে তিনদিন ভাস্করের সাথে দেখা হয়। রাত্রে মাঝে মাঝে ব্রততীর সাথে গল্প করে।
এই ছয় মাসে ব্রততী বড়দার আগের বৌ বা সবার সুলগ্না বৌদিকে নিয়ে প্রায় সব কিছুই জেনে নিয়েছে। এই পরিবারে সবাই যাতে মেনে নেয় তাই নিজেকে সুলগ্নার মত করার চেষ্টা করেছে। আস্তে আস্তে ব্রততী বড়দার সব টাকা পয়সার খবর জেনে নেয়। একদিন রাতে ব্রততী বড়দাকে জিজ্ঞাসা করে মানসীর আয় নিয়ে।
(এখানে বড়দা যদিও ব্রততীর বড়দা নয়, ব্রততী ওনাকে অন্য নামে ডাকতো। আমি বড়দার নাম লিখতে চাই না বা অন্য নামও দিতে চাই না। তাও বড়দা বলেই লিখছি)।
ব্রততী – রাঙ্গাদির পার্লার থেকে কত আয় হয় ?
বড়দা – সে তুমি জেনে কি করবে ?
ব্রততী – কিছু করবো না। তবু জানা দরকার।
বড়দা – কেন ?
ব্রততী – আমার মনে হয় তোমার জীবনের সব কিছু জানারই অধিকার আমার আছে
বড়দা – সে তো আছেই। আমি তোমার কাছে কেন লুকাবো বল !
ব্রততী – তবে বল রাঙ্গাদির পার্লার থেকে মাসে কত আয় হয় ?
বড়দা – এখন মাসে ১২ থেকে ১৪ হাজার টাকা আয় হয়। পুজোর সময়ে বা বিয়ের মরশুমে ২০ হাজারও হয়।
ব্রততী – সে টাকা দিয়ে তুমি কি করো ?
বড়দা – আলাদা করে কিছুই করি না। ওকে মাসে ১৫০০ টাকা দেই ওর হাত খরচের, বাকিটা সংসারেই খরচ হয়।
ব্রততী – তোমাদের এই তিন ভায়ের সংসার চালানোর দায়িত্ব কি রাঙ্গাদির ?
বড়দা – তা কেন, আমার বাকি দুই ভাইও টাকা দেয়।
ব্রততী – ১০ হাজার করে দেয় কি ?
বড়দা – না না ওত দেয় না।
ব্রততী – আর তোমার কোন খরচই নেই
বড়দা – না মানে ঠিক তা না।
ব্রততী – আমি বুঝতে পারছি। সবই বুঝতে পারছি।
বড়দা – কি ? কি বুঝতে পারছ ?
ব্রততী – এই যে রাঙ্গাদি সাদাসিধে ভাল মেয়ে বলে তোমরা যা ইচ্ছা তাই করছ।
বড়দা – ওর খাওয়া পড়া সব কিছুরই দায়িত্ব আমার।
ব্রততী – সব কিছুর দায়িত্ব তো নাও নি
বড়দা – কোন দায়িত্ব নেই নি ?
ব্রততী – বিয়ে দিয়েছ ?
বড়দা – সেটা করতে পারিনি
ব্রততী – নিজে দুবার বিয়ে করতে পারলে আর বোনের একবার বিয়ে দিতে পারলে না !
(#১৬)
বড়দা – এখন তুমি কি চাও ?
ব্রততী – রাঙ্গাদির পার্লার কত দিন ধরে চলছে ?
বড়দা – প্রায় ১২ বছর।
ব্রততী – তুমি পার্লারের সব কিছু রাঙ্গাদির নামে করে দেবে।
বড়দা – ঠিক আছে করে দেবো।
ব্রততী – রাঙ্গাদির নামে ব্যাঙ্কে একটা আকাউন্ট খুলে দেবে। পার্লারের সব আয় ওইখানে রাখবে।
বড়দা – সে কি করে হবে ?
ব্রততী – কি করে হবে জানিনা। আমি যা বলছি তাই করবে। আর সংসারে তোমরা তিন ভাই যত করে দাও রাঙ্গাদি তার অর্ধেক দেবে।
বড়দা – কেন অর্ধেক কেন ?
ব্রততী – তোমাদের সবার বৌ ছেলে মেয়ে আছে। রাঙ্গাদি একা, তাই।
বড়দা – ঠিক আছে সে সব হয়ে যাবে।
ব্রততী – হয়ে যাবে না, সামনের রবিবার সব ভাই, বৌ, মাআর রাঙ্গাদির সামনে এই সব বলে বুঝিয়ে দেবে।
বড়দা – ঠিক আছে তোমার সব কথা মেনে নিলাম। এবার খুশী ?
ব্রততী – এখনও সব শেষ হয় নি
বড়দা – আবার কি বাকি আছে ?
এইবার ব্রততী যা বলল বাড়ির ওপর অ্যাটম ব্যোম পড়লেও বড়দা এতো চমকাতেন না।
ব্রততী – গত বার বছরের পার্লারের আয় বাবদ তুমি রাঙ্গাদিকে ১২ লক্ষ টাকা দেবে।
বড়দা – মানে ?
ব্রততী – আমি কি বলছি তুমি ঠিকই বুঝে পারছ ?
বড়দা – আমি এতো টাকা কোথায় পাবো ?
ব্রততী – আমি জানি তোমার কোথায় কত টাকা আছে।
বড়দা – এতো টাকা মানসীকে দিয়ে দিলে আমরা খাবো কি ?
ব্রততী – সে আমি কি জানি ! তুমি কি আমাকে রাঙ্গাদির আয়ের ভরসায় বিয়ে করেছো ?
বড়দা – না তা নয়, কিন্তু...
ব্রততী – দেখো আমি যে কোন অযৌক্তিক কথা বলিনি সেটা তুমি ভাল করেই জান।
বড়দা – না না তুমি যা বলেছ তা ঠিকই বলেছ
ব্রততী – তবে রাঙ্গাদিকে কবে দিচ্ছ ১২ লক্ষ টাকা ?
বড়দা – ও কি করবে এতো টাকা দিয়ে ?
ব্রততী – তোমার কি যায় আসে তাতে ? ওকে ওর মত চিন্তা করতে দাও।
বড়দা – আমি একা দেবো এতো টাকা ?
ব্রততী – সে তুমি দেখো, তুমি একা দেবে না ভাইদের কেও বলবে সেটা তোমার ওপর নির্ভর করছে।
বড়দা – মানে ?
ব্রততী – তোমার মুখে এতো মানে মানে ভাল শোনায় না। তুমি সব বুঝতে পারছ। ভাইদেরকে কিভাবে বোঝাবে টাকা দেওয়ার কথা সে তুমি জান। আমি ওর মধ্যে নেই।
বড়দা – বেশ সুবিধাবাদী তো তুমি
ব্রততী – কে কতটা সুবিধাবাদী সে তুমি ভাল করেই জানো। তুমি আমার স্বামী তাই আমার যা বলার তোমাকেই বলবো। এই বাড়ির যে দোতলার ঘর গুলো বানিয়েছ তার বেশীর ভাগ খরচ ওই রাঙ্গাদির টাকা থেকেই এসেছে। আমি তোমাকে ওই ওপর তলাটা রাঙ্গাদির নামে করে দিতে বলছি না। এই ওপর তলায় তোমরা তিন ভাইই থাকো। তাই তোমার ভাইরা এই টাকা শেয়ার করবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু একথা তুমি তোমার ভাইদের বোঝাবে।
বড়দা – আর কিছু ?
ব্রততী – না গো, আর কিছু চাই না তোমার কাছে।
বড়দা – একটা কথা বল, তুমি মানসীর জন্যে এতো কেন ভাবছ ?
ব্রততী – আমি মানসীর জন্যে ভাবছি না। আমি আমার নিজের সুখের জন্যে ভাবছি।
বড়দা – মানসীকে টাকা দিলে তোমার সুখ কি ভাবে আসবে ?
ব্রততী – দেখো আমরা সবাই স্বার্থপর। আমি তোমাকে ভালবাসি। আমি চাই তুমি সবার ওপরে থাকো। এই পরিবারে যে ভাবেই হোক তুমি তোমার সব দায়িত্ব পালন করেছো। শুধু রাঙ্গাদিকে ছাড়া।
বড়দা – তার কিছু কারন আছে।
ব্রততী – যাই কারন থাক, সেটা তোমার দরকার ছিল। রাঙ্গাদির নয়।
বড়দা – হয়ত তাই
ব্রততী – আমি যা যা করতে বললাম, তাতে তোমার সন্মান অনেক অনেক বাড়বে। আর বাড়িতে সবার মনে তুমি আরও বড় আসন পাবে। আর আমার স্বামীকে সবাই ভাল বললে সেটা আমারি সুখ।
বড়দা – বড়ই জটিল চিন্তা তোমার।
ব্রততী – এটাই সব থেকে সাধারন চিন্তা। তুমি যদি রাঙ্গাদিকে ১২ লক্ষ টাকা দিতে না পারো, আমি আমার সব গয়না বিক্রি করে দেবো। কিন্তু রাঙ্গাদিকে বঞ্চিত করে নিজে সুখে থাকতে পারবো না।
বড়দা – তুমি এতো চিন্তা করো আমার বোন, আমার সন্মান, আমার মা ভাইদের নিয়ে ?
ব্রততী – যেদিন তোমায় বিয়ে করেছি, সেদিন থেকেই তোমার সব কিছু তো শুধু তোমার বা আমার নয়। সবই আমাদের, তাই এই চিন্তা।
এরপর আরও অনেকক্ষণ ওদের দুজনের কথা চলে। তারপর একসময় দুজনেই ঘুমিয়ে যায়। বড়দার একটু দেরি হয়, কারন এতগুলো টাকার দুঃখ সহজে হজম করতে পারছিলেন না। ব্রততী ওর যুক্তি দিয়ে এমন ভাবে বুঝিয়েছে বড়দা কিছুই বলতে পারেন নি। মেনে নিয়েছেন কিন্তু মনে ঠিক নিতে পারেন নি।
(#১৭)
পরের রবিবার বড়দা শ্রদ্ধা আর স্বপনকেও ডাকেন। শ্রেয়সী আর শ্যামলও আসে। ব্রততীর কথা অনুযায়ী সব কিছুই সবাইকে জানান। উপস্থিত কেউই বড়দার এই উদার মনোভাবের জন্যে প্রস্তুত ছিল না।
মানসী – না না আমি ওত টাকা নিয়ে কি করবো ?!
মা – কোথায় পাবি বাবা ওত টাকা ?
দুই ভাই – এতদিন ওই টাকা তুমি রেখেছ তাই ওকে টাকা তুমিই দেবে।
শ্রদ্ধা – এর থেকে ভাল কিছুই হতে পারে না।
শ্রেয়সী – আমাকে কিছু দেবে না ?
স্বপন – বড়দা আমি সব সময় ভাবতাম আপনি রাঙ্গাদিদি কে ভাল বাসেন না। আজ বুঝলাম আমি খুব ভুল ভাবতাম।
ব্রততী – রাঙ্গাদি কে রাঙ্গাদির টাকা ফেরত দিচ্ছে, এতে কোন মহত্ব নেই। এতদিন ওই টাকা তোমাদের দাদার কাছে ছিল। এখন রাঙ্গাদি অনেক ম্যাচিওর। নিজের টাকা সামলানোর ক্ষমতা আছে। তাই এবার থেকে রাঙ্গাদির পার্লারের সব দায়িত্ব, লাভ বা লোকসান রাঙ্গাদির।
মানসী – পার্লার আমিই সামলাবো। শুধু আমাকে পার্লারের হিসাব রাখার জন্যে দীপ্তির সাহায্য চাই।
দীপ্তি – রাঙ্গাদি আমি সব সময় তোমার সাথেই আছি।
মানসী – আর দীপ্তি এতদিন ওই পার্লারের জন্যে অনেক কিছু করেছে। দাদা যদি আমাকে ১২ লক্ষ টাকা দেয় তার থেকে অন্তত ২ লক্ষ টাকা দীপ্তির পাওয়া উচিত।
দীপ্তি – না না আমার কোন টাকা চাই না।
ব্রততী – রাঙ্গাদি ওই টাকা নিয়ে কি করবে সেটা রাঙ্গাদিই ঠিক করবে।
শ্রেয়সী – আমাকে কিছু দিবি না ?
শ্যামল – তুমি সব সময় টাকা টাকা করবে না। তুমি আজ পর্যন্ত কি করেছো ওই পার্লারের জন্যে যে তোমাকে টাকা দেবে ? আর আমার যে ‘আয়া সেন্টারের’ ব্যবসা সেটা বড়দা আর আমার স্বর্গীয় শ্বশুরের টাকা দিয়েই শুরু করেছি। তোমাকে দাদা অনেক দিয়েছে। আর কত দেবে !
শ্রেয়সী – না মানে আমি এমনি বলছিলাম।
শ্যামল – তুমি কেমনি বলছিলে সেটা আমিও বুঝি, বাকি সবাইও বোঝে।
ব্রততী – না না শ্যামল এভাবে বল না শ্রেয়সীকে।
শ্রেয়সী – দেখো না বৌদি সব সময় এইভাবেই আমাকে খোঁটা দেয়
শ্রদ্ধা – শ্যামল মোটেই তোমাকে খোঁটা দিচ্ছে না। ও তোমাকে সত্যি কথাটা জানাচ্ছে।
এইরকম আরও অনেক কথা দিয়ে ওদের আলোচনা চলতেই থাকে। কিছু পড়ে বড়দা ‘একটা মিটিং’ আছে বলে চলে যান। অভ্যেস মত স্বপন উঠে রাঙ্গাদির ঘরে যায়।
(#১৮)
মানসী নিজের ঘরে ঢুকে চুপ করে বসে থাকে। খাটের ওপর বাবু হয়ে বসে দুই হাতের ওপর থুতনি রেখে ভাবতে থাকে। কখন স্বপন এসে বসেছে বুঝতেও পারেনি। চোখ থেকে একটু একটু জল গড়িয়ে পড়ছিল। স্বপন দেখে ওর রাঙ্গাদির চোখে জল কিন্তু কিছু বলে না। ও রাঙ্গাদির মুখের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে। এমন সময় দীপ্তি আর নীহারিকা চা নিয়ে ঢোকে।
দীপ্তি – কি ব্যাপার রাধা কৃষ্ণের ? রাধার চোখে জল আর কৃষ্ণ তাকিয়ে রয়েছে !
মানসী দীপ্তির গলা শুনে চমকে ওঠে।
মানসী – চুপ কর মুখপুড়ি, সব সময় ইয়ার্কি। স্বপন তুমি কখন আসলে ?
স্বপন – দশ মিনিট হবে, তোমার চোখের জল দেখছিলাম
মানসী – আমি কাঁদছিলাম নাকি !
দীপ্তি – হ্যাঁ কাঁদছিলেই তো। চোখে হাত দিয়ে দেখো
মানসী চোখে হাত দিয়ে বলে, “এমা তাইতো, বুঝতেই পারিনি!”
স্বপন – কেন কাঁদছিলে রাঙ্গাদি ?
মানসী – কি জানি কেন কাঁদছিলাম
স্বপন – তবে কি ভাবছিলে এতো গভীর ভাবে ?
মানসী – আজকে আমি বাড়ি থেকে আলাদা হয়ে গেলাম
দীপ্তি – মোটেও তুমি আলাদা হলে না
মানসী – আলাদা ছাড়া কি হলাম ?
স্বপন – তুমি অর্থনৈতিক স্বাধীনতা পেলে
মানসী – সেটা আবার কি বস্তু !
স্বপন – তুমি গত ১২ বছরেরও বেশী সময় ধরে পার্লার চালাচ্ছ। পার্লার থেকে আয়ও ভালই হয়। কিন্তু সেই লাভের টাকা তুমি খরচ করতে পারতে না।
মানসী – দাদা তো দেখত
দীপ্তি – এই মেয়ে কোনদিন বুঝবে না
স্বপন – আর কতদিন দাদার ওপর নির্ভরশীল থাকবে ? এবার তো বড় হও। নিজের কাজ নিজে দেখো।
মানসী – সেতো দেখছিই
স্বপন – এবার টাকাটাও সামলে রাখবে। লাভের টাকা কিভাবে কোথায় জমাবে না অন্য ব্যবসায় খাটাবে সেটা তুমি চিন্তা করবে।
মানসী – আমার যেন কিরকম স্বার্থপর বলে মনে হচ্ছে
স্বপন – দেখো এটা হল নিজের ভবিষ্যতের চিন্তা নিজের মাথায় নেওয়া। তোমাকে তো বাড়ির কাজের জন্যে টাকা খরচ করতে মানা করছি না। আমি শুধু বলছি তোমার আয় কিভাবে খরচ হবে সেটা তুমি ঠিক করবে। তোমার হয়ে বড়দা ঠিক করবে না।
মানসী – এইবার বুঝলাম। কিন্তু সেটা কি ঠিক হচ্ছে ?
স্বপন – এটাই ঠিক হচ্ছে, এতদিন ঠিক হয়নি।
নীহারিকা – দেখ রাঙ্গাদি তোর ভাই আর দুই দাদার কত আয় সেটা কি বাকিরা জানে ?
দীপ্তি – আমার মনে হয় না তোমার ভাই সব আয় ব্যায়ের হিসাব দাদাকে দেয়
স্বপন – দেওয়ার দরকারও নেই
দীপ্তি – আমিতো রাঙ্গাদিকে গত দু বছর ধরে এইটাই বোঝাতে চেয়েছি
নীহারিকা – হটাত বড়দা এতো উদার হয়ে গেল কেন !
স্বপন – আমার মনে হয় এটা নতুন বৌদির জন্যে হয়েছে
দীপ্তি – আমারও তাই মনে হয়। গত বুধবার রাতে বড়দা আর দিদি অনেক রাত পর্যন্ত কথা বলেছে।
মানসী – আর তুই বাইরে থেকে আড়ি পেতে শুনছিলি !
দীপ্তি – না না, আমি বাথরুমে গিয়েছিলাম
মানসী – রাতে আবার তোর বাথরুম যাবার দরকার কেন হয় ? তুই তো জলই খাস না !
দীপ্তি – আরে বাবা তোমার ভাই করার পরে গুদ ধুতে গিয়েছিলাম।
মানসী – সব সময় অসভ্য কথা !
স্বপন – আসল কথা বলো, রাঙ্গাদি অন্য কথা জিজ্ঞাসা করো না
দীপ্তি – বড়দার গলা শুনলাম “আমি এতো টাকা দিয়ে দিলে খাবো কি”
স্বপন – তারপর
দীপ্তি – দিদি বলে “নিজের যা আছে তাই খাবে”
স্বপন – তাই ভাবি বড়দার এতো পরিবর্তন কেন। তবে যা হয়েছে ভালই হয়েছে।
নীহারিকা – ভাল হয়েছে মানে ভীষণ ভাল হয়েছে।
স্বপন – তবে দেখো দীপ্তি, তুমি আর লেখা বৌদি যা ভাবো নতুন বৌদিকে নিয়ে সেটা ঠিক নয়
দীপ্তি – না না দিদি খুব ভাল। কিন্তু...
স্বপন – কিন্তু কি ?
দীপ্তি – আমাদের ভয় লাগে, ওইরকম কলেজের প্রোফেসরের মত থাকে, ঘরের দিদি বলে মনে হয় না।
নীহারিকা – যে ভাবেই থাক, তোমাদের জন্যে তো চিন্তা করে
দীপ্তি – সেটা কাল রাতে বুঝতে পারলাম
স্বপন – সেটা আমি প্রথম দিনই বুঝেছি আর তোমাদের বোঝানোর চেষ্টা করেছি।
(#১৯)
সোমবারে মানসী আর ভাস্করের দেখা হলে মানসী সব বলে ভাস্করকে। আরও বলে যে ওর মনে হচ্ছে ওর নতুন বৌদি আসাতে ওদের বিয়ে করতে আর কোন অসুবিধা হবে না। ভাস্কর মানসীর হাত ধরে বসে থাকে।
অনেকক্ষণ বসে থেকে ভাস্কর বলে যে ও আর অপেক্ষা করতে পারছে না।
মানসী – চলো তবে কালকেই বিয়ে করে ফেলি
ভাস্কর – তোমার দাদা মেনে নেবে ?
মানসী – দাদা মেনে নেওয়ার আগে অন্য কথা আছে ?
ভাস্কর – কি কথা ?
মানসী – আমরা দুজনে কি বিয়ে করতে প্রস্তুত আছি ?
ভাস্কর – আমারও ভয় লাগে। আর একটা কথা তোমাকে আগে বলিনি সেটা বলতে চাই।
মানসী – কি বল ?
ভাস্কর – আমি তোমাকে বিয়ে করলেও আমার বাড়িতে নিয়ে যেতে পারবো না।
মানসী – কেন ? সে আবার কি কথা ?
ভাস্কর – সেটা আরেকটা সমস্যা
মানসী – কি সমস্যা সেটা বল
ভাস্কর – আমি ওই সমস্যা তোমাকে কি করে বলি সেটা ভেবে পাচ্ছি না।
ভাস্কর – ভীষণ লজ্জার ব্যাপার
মানসী – যতই লজ্জার কিছু হল একদিন না একদিন তো জানবোই। তাই আজই বলে ফেল।
ভাস্কর – ভুদেব কাকু
মানসী – সে আবার কে ?
ভাস্কর – ভুদেব কাকু বাবার বন্ধু ছিল। আমার বাবা বেঁচে থাকতেই সেই কাকুর সাথে আমার মায়ের একটা সম্পর্ক ছিল
মানসী – তোমার বাবা জানতেন ?
ভাস্কর – মনে হয় জানতেন, কিন্তু কোন কারনে কিছু বলতেন না বা বলতে পারতেন না
মানসী – তাতে এখন কি হয়েছে ?
ভাস্কর – ওই ভুদেব কাকু এখন রোজ রাতে এসে আমার মায়ের সাথে থাকে
মানসী – ওনার বিয়ে হয় নি ?
ভাস্কর – অনের বৌ অনেক আগেই ওনাকে ছেড়ে চলে গেছে। আমি তখন দুবাই থাকতাম। তাই সেসব ঠিক জানি না
মানসী – তোমার মাকে জিজ্ঞাসা করো নি ?
ভাস্কর – মা মানুষের সব থেকে শ্রদ্ধার জায়গা। আমার ইচ্ছা করে না মায়ের সাথে এইসব কথা বলতে।
মানসী – তোমার মা তোমার অযত্ন করেছে কখনও ?
ভাস্কর – না না মা আমাকে খুব ভালবাসে
মানসী – তবে আর অসুবিধা কোথায়
ভাস্কর – আমার ওই ভুদেব শুয়োরের বাচ্চাটাকে পছন্দ নয়
মানসী – বাবা মায়ের বন্ধুর সম্বন্ধে এইভাবে কথা বলতে নেই সোনা
ভাস্কর – সেই জন্যেই তো কিছু বলি না। মাও ওনার সাথে একটু শান্তিতে থাকে। তবে...
মানসী – তবে কি ?
ভাস্কর – ভুদেব কাকুর অন্য মেয়ে দেখলেই প্রেম জেগে ওঠে। উনি যেখানে থাকবেন সেখানে আমি তোমাকে নিয়ে যাবো না।
মানসী – আমাকে কেউ কিছু করতে পারবে না
ভাস্কর – সে পারুক আর নাই পারুক আমি তোমাকে বিয়ে করে ওখানে নিয়ে যাবো না।
মানসী – তবে আমরা বিয়ে করে থাকবো কোথায়
ভাস্কর – সেটাই তো সমস্যা
ওই চায়ের দোকানের মাসী ওদের সব কথাই শোনেন। মানসী বা ভাস্করও ওনার সামনে কিছু লুকায় না। তবে সাধারণত মাসী ওদের মধ্যে কোন কথা বলে না। সেদিন মাসী চুপ থাকে না।
মাসী – তোমাদের সমস্যার একটা সমাধান আছে আমার কাছে।
(#২০)
মাসী – দেখো বাবা আমি একা একা থাকি। আমার একটা ঘর খালিই পড়ে আছে। তোমরা ওখানে এসে থাকো।
মানসী – না না মাসী তা হয় না
মাসী – কেন মা, আমি তোমাদের কেউ না বলে আমার বাড়িতে থাকবে না ?
মানসী – না মাসী তা নয়, তবে...
মাসী – তবে কি ? তুমি কি ভাবছ আমি তোমাদের টাকা আছে শুনে থাকতে দিতে চাইছি ?
মানসী – ছি ছি মাসী সেইরকম ভাববো কেন !
মাসী – দেখো আমারও তো বয়েস হল, একা থাকি। একটু ভয় ভয় লাগে।
ভাস্কর – আপনার ছেলে এলে কোথায় থাকবে ?
মাসী – আমার ওই ঘর ছেলে বৌয়ের জন্যেই তোমার মেসোমশায় বানিয়েছিলেন। কিন্তু সেতো গত দশ বছরে একবারও আসেনি।
ভাস্কর – ভাড়া দিয়ে দেন না কেন ?
মাসী – একই ঘরের মধ্যে অচেনা কাউকে ভাড়া দিতে সাহস হয় না
মানসী – আমরাও তো অচেনা
মাসী – তোমরা অচেনা কেন হবে ? এতদিন ধরে দেখছি। মানুষ চিনতে সব সময় ভুল হয় না।
মানসী – তাও কেমন কেমন লাগছে। তবে মাসী ভাড়া নিতে হবে।
মাসী – দেখো ছেলে বৌয়ের জন্যে ঘর বানিয়েছিলাম। ওরা তো থাকল না, মেয়ে জামাইই না হয় থাকবে। আর মেয়ের কাছ থেকে কেউ ভাড়া নেয় নাকি !
মানসী আর ভাস্কর কি বলবে ভেবে পায় না। এই পৃথিবীতে যাদের ওরা নিজের বলে জানত তাদের প্রায় কারো কাছ থেকেই কোন সহায়তা পায়নি। আর যাদের কে চেনে না বা জানে না তাদের কাছ থেকেই অযাচিত ভাবে সাহায্য পেয়ে যাচ্ছে। ভাস্করের মুখ খুশীতে ভরে ওঠে। মানসী মেয়ে, আর মেয়েদের সুখে কেঁদে ফেলাটাই নিয়ম। তাই ও কেঁদে ফেলে আর মাসীকে জড়িয়ে ধরে।
মাসী – দেখো এই সংসারে সবাই সুখে থাকতে চায়। আমি আর তোমার মেসোমশায় ছেলেকে নিয়ে সুখেই ছিলাম। অনেক স্বপ্নও দেখেছিলাম। কিন্তু ছেলে বড় হয়ে নিজের সুখ বেশী করে দেখল, বাবা মায়ের সুখের কথা একটুও ভাবল না।
মানসী – আমরা থাকলে তোমার সুখ কেন হবে ?
মাসী – একা থাকলে পান্তা ভাতই খাই বা রাজভোগ খাই, সুখ আসে না। তোমরা সাথে থাকলে সেই সুখ পাবো।
মানসী – ঠিক আছে আমরা বিয়ে করে মাসী তোমার কাছেই আসবো।
মাসী – তোমরা কাল থেকে আমার দোকানে দেখা না করে, আমার বাড়িতে বসে গল্প করো।
মানসী – যাঃ তাই হয় নাকি, পাড়ার কে কি বলবে ?
মাসী – পাড়ার লোকে কি বলল তা নিয়ে তোমাদের চিন্তা করতে হবে না। তোমার পেছনে লোকে কি বলে সেটা তোমার সমস্যা হওয়া উচিত নয়। তোমরা ঠিক থাকলে বা পাপ না করলে লোকের কোথায় কি আসে যায় !
মাসী ওদেরকে নিয়ে গিয়ে বাড়ি দেখিয়ে দেয়। বেশ ছোট খাট সুন্দর দুটো ঘর। মাসী একা আর বয়েসের জন্যে ঠিক মত পরিস্কার করতে পারেন না। মাসী ঘরের একটা চাবি ভাস্করকে দিয়ে দেন।
মানসী – আমাকে মেয়ে বললে কিন্তু চাবি দিলে ওকে ?
মাসী – তোমাকে যেমন মেয়ে বলেছি, ভাস্কর কেও ছেলের মত ভাবছি।
ভাস্কর – তোমার ইচ্ছা হলে চাবি তুমি রাখ
মানসী – না রে বাবা, আমি এমনি বলছি। চাবি তুমিই রাখ। পারলে সময় করে এসে সব পরিস্কার করে রেখ।
ভাস্কর – আমি পরিস্কার করবো আর তুমি হাওয়া খাবে ?
মানসী – তুমি পরিস্কার করবে আর আমি সাজাবো। দুজনে মিলে আমাদের সুখ আর মাসীর সুখ বাড়িয়ে তোলার চেষ্টা করবো।
মাসী – আজ থেকেই আমি আর একা নই মা। আমি খুব সুখী।
পরের দিন থেকে ভাস্কর রোজ বিকালের দিকে এসে ঘরের সব কিছু পরিস্কার করে। মানসী সব সময় পার্লার ছেড়ে আসতে পারে না। তাও ওদের আগেকার মত সপ্তাহে তিনদিন আসে। ভাস্করের সাথে প্রেম করে আর সংসারের স্বপ্ন দেখে। ভাস্কর প্রথম দিনই বলে দেয় যে ওরা ওই ঘরে একা থাকলেও, যতদিন না বিয়ে হচ্ছে চুমু খাওয়া ছাড়া কিছু করবে না।
ষষ্ঠ পরিচ্ছদ সমাপ্ত