জীবন যে রকম - একটি উপন্যাস_Written By Lekhak (লেখক) [১১শ খন্ড (চ্যাপ্টার ৩১ - চ্যাপ্টার ৩৩)]
জীবন যে রকম - একটি উপন্যাস
Written By Lekhak (লেখক)
।।একত্রিশ।।
শুক্লা বলল, "দেব তোর মনে আছে, আমাদের সেই পিকনিকের কথা? টাকী বসিরহারটে আমরা পিকনিক করতে গিয়েছিলাম। সৌগত জেদ ধরল, ডায়মন্ড হারবারে যাবে। আর তুইও গোঁ ধরে বসলি, পিকনিক হলে টাকীতেই যাবি। শেষ পর্যন্ত তোরই জিত হল। আর আমরা হৈ হৈ করে পিকনিকটা সেরে এলাম।"
শুক্লাকে বললাম, "হ্যাঁ মনে আছে। সেদিন তুই আর সৌগত আমাদেরকে ছেড়ে কোথায় চলে গেলি। শেষমেষ খুঁজে পাই না। শুভেন্দু, রনি সবারই খুব চিন্তা লেগে গিয়েছিল সেদিন।"
শুক্লা বলল, "হ্যাঁ জায়গাটা অত সুন্দর। সৌগতও আগে ভাবেনি। ও ভেবেছিল ডায়মন্ডহারবারের থেকে ভালো বোধহয় কিছু হয় না। নিজের চোখে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করে না। মাঝে একটা নদী, এদিকে এপার বাংলা ওদিকে ওপার। চারিদিকে সারি সারি শুধু নারকেল গাছ, এত মনোরম, এতো সুন্দর, এমন একটা পিকনিক স্পট। না এসে পারা যায় না। সারাটা রাস্তা সৌগতর যে রাগটা ছিল, ওখানে গিয়ে একেবারে জল হয়ে গেল। আমাকে বলল, চলো না হাঁটতে হাঁটতে দুজনে একটু ওদিকটায় যাই। তোরা সেই সময় আড্ডা দিচ্ছিলি। ঠিক সেই সময় সৌগত আমাকে নিয়ে বেশ কিছুটা দূরে চলে গেল। আমি যত বলছি, আর যেও না। ওরা চিন্তা করবে। ও ততই দূরে নিয়ে যাচ্ছে আমাকে।"
শুক্লাকে বললাম, "সৌগত তোকে ইচ্ছে করেই আমাদের থেকে দূরে নিয়ে গিয়েছিল। লুকিয়ে তোকে আদর করবে বলে। ডায়মন্ড হারবার হলে সেই সুযোগটা পেত না।"
শুক্লা বলল, "হ্যাঁ, সেদিন সৌগত সত্যিই খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিল। কাছে পিঠে যে এমন সুন্দর একটা জায়গা আছে ও জানতই না। আমি সাথে থাকা মানে ও তখন অন্যমানুষ। গালফ্রেন্ড প্রেমিকা বলে কথা। ঠিক যেন সুযোগ সন্ধানী পুরুষ। আমাকে বলল, জানো শুক্লা, আমার মনে হচ্ছে, ফ্যামিলি প্ল্যানিংটা আজ এখানেই আমরা সেরে ফেলি। তোমার যদি আপত্তি না থাকে?"
আমি শুক্লার কথা শুনছিলাম আর হাসছিলাম। শুক্লা বলল, "কি অসভ্য বলতো? আমাকে বলল, এদিকটা ফাঁকা। কেউ আসবে না। চলো তুমি আর আমি কাজটা সেরে ফেলি।"
শুক্লাকে বললাম, "আসলে সৌগত বরাবরই খুব ডেসপারেট ছিল। আসলে আমাকে আর বিদিশাকে প্রেম করতে দেখে, ওর মধ্যে এই জেদটা চেপে গিয়েছিল। বিদিশা আর আমি....."
কথাটা বলেই আমি হঠাৎ থেমে গেলাম। শুক্লা বলল, "কি হলো? থামলি কেন? বল....."
আমি বললাম, "না, তুই বল, আমি শুনছি।"
শুক্লা বলল, "আমার খুব ভুল হয়েগিয়েছিল দেব, জানিস তো। অকারণে সৌগতকে আমি সন্দেহ শুরু করলাম। ওই অবাঙ্গালী মেয়েটাকে নিয়ে ওর আদিখ্যেতা সহ্য করতে করতে আমারও একদিন ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল।"
শুক্লাকে বললাম, "জীবনের এই ভুল গুলোই তোকে এখন কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। সবাই কিছু ভুল করে। আমিও করেছি। তার ফল ভোগ করছি এখন।"
শুক্লা বলল, "তুই তো কোনো ভুল করিস নি দেব। আমি তো মনে করি তুই ই এতদিনে সঠিক আছিস। তোকে যে ভুল বোঝার সে তোকে ভুল বুঝে ছেড়ে চলে গিয়েছিল।"
তারপর নিজেই বলল, "না না, আমি ভুল বললাম। বিদিশা ভালো মেয়ে। ও তো তারপরেও ভুল বুঝেছিল। কিন্তু সৌগত তো সেভাবে আমাকে....."
আমি বেশ অবাক হলাম। শুক্লাকে বললাম, "কেন, সৌগত তো তোকে....."
- "ভালবাসত? তাহলে আমাকে ও জোর করল না কেন? আমার কথাটা মেনে নিল না কেন? আমার ভুলটাকে ভাঙানোর চেষ্টা করল না কেন? নিজের ইগোকে বজায় রেখে, ও বিয়ে করে বসলো আর একটা সুন্দরী মেয়েকে। সত্যিকারের ভালোবাসার এই কি দাম? আমি ভুল করে বসলাম। তার জন্য সৌগত আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করল না? আমাকে এভাবে শাস্তি দিল?"
মানুষ সবসময় ভালো কিছু পেতে চায়। যখন ভালোর থেকে খারাপই কিছু জোটে, তখন ভাবে যেটা আমার ছিল, সেটাই বোধহয় ভালো ছিল। শুক্লা হয়তো ভেবেছিল, মাসীর পছন্দ করা সুপাত্রই বোধহয় ওর জীবনে সুখ স্বাচ্ছন্দ্য এনে দেবে। কপালের দোষে সেটাও যখন হল না, তখন শুক্লার জীবনে নেমে এল কালো ছায়া। চরম এক আফসোস, এর থেকে সৌগতই বোধহয় পাত্র হিসেবে ওর সন্মন্ধ করা বরের থেকে ভালো ছিল।
শুক্লাকে বললাম, "তোর বিয়ের পরবর্তী ঘটনাটা আমি জানি না। তবে চোখের সামনে যা সব ঘটছে, এখন মনে হচ্ছে বিয়ে থা না করে এভাবেই জীবনটা আমি কাটিয়ে দেবো। বলা যায় না, আমার জীবনেও যদি এরকম কিছু ঘটে যায়।"
শুক্লা বলল, "বল তুই একজনকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করবি না, তাই তো?"
আমি বললাম, "সেই একজনটা কে? সেটাই তো জানবার চেষ্টা করছি।"
শুক্লা বলল, "কেন? বিদিশা? যে তোর জীবনে আবার ফিরে এসেছে।"
কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম, আমার মুখে কোন কথা নেই। শুক্লা এগিয়ে এল আমার দিকে, আমার হাত দুটো ধরে বলল, "সরি দেব, আমি জানি, বিদিশার কথা তুললেই, তুই কিরকম অন্যরকম হয়ে যাস। আমি বিদিশার কথা আর তুলবো না। এই আমি কান ধরছি।"
মুখের সামনেই ওভাবে দুটো কান ধরছে দেখে, ওকে বললাম, "কি পাগলামো করছিস? আমি কিছু মনে করিনি। বল তুই কি বলছিস, আর কান ধরতে হবে না। হাতটা নামা। যা বাজে লাগছে।"
শুক্লা বলল, "দেব, একটা কাজ করবি, পুরোনো প্রেমকে কিভাবে আবার চাগাতে হয়, আমাকে একটু শিখিয়ে দিবি? আমি তো চেষ্টা করে যাচ্ছি, কিন্তু মনে ঠিক বল পাচ্ছি না। তোর তো তাও একটা উৎস আছে, একটা প্রেরনা আছে। এতদিন বাদে একটা হারিয়ে যাওয়া রাস্তাটা খুঁজে পেয়েছিস। কিন্তু আমি কাকে পাই? আমারো যে কাউকে দরকার, যে আমাকে শক্তি যোগাবে, প্রেরণা যোগাবে। সেরকম তো কাউকে পাচ্ছি না।"
আমি কি ওর কথার উত্তর দেবো বুঝতে পারছি না। হাঁ করে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছি। দেথছি, শুক্লা ছলছলে চোখ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর দৃষ্টিতে প্রাণ আছে, কিন্তু প্রাণটা এই মূহূর্তে দেহ থেকে বেরিয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছে। মুখে কোনো ভাষা নেই। যেন একটা শরীর দলা পাকিয়ে দুমড়ে মুচড়ে যাবে বলে মনে হচ্ছে।
আমাকে ছলছলে চোখ নিয়েই বলল, "দেব আমাকে মরার একটা উপায় বলে দিবি। এভাবে বাঁচতে আমার আর ভালো লাগছে না। তোকে মনের কথাটা এতক্ষনে বললাম।"
চোখ দিয়ে টসটস করে জল গড়িয়ে পড়ছে। ওর কাঁধে হাত দিয়ে বললাম, "এ কি রে? তুই এত আপসেট হয়ে পড়েছিস? কেন কাঁদছিস তুই? এভাবে কাঁদিস না। শুক্লা....."
শুক্লা এবার কাঁদতে আমার গায়ে ঢলে পড়ল। একটা সান্তনা দেবার মতন ওর পিঠটাকে ধরলাম। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলাম। শুক্লাকে বললাম, "কাঁদিস না। দেখ তুই আমাকে বাড়ীতে ডেকে আনলি, আমারই খারাপ লাগছে।"
হাত দিয়ে ওর শরীরটাকে ধরে ওকে তুলে বসাতে যাব, দেখলাম, শুক্লা ওই কান্না নিয়েই আমার বুকে মুখ ঘসছে। কিছু হারাবার ভয়ে, ওই ভাবে মুখ ঘষে নিজেই নিজের সান্তনা খুঁজছে। আমি শুক্লাকে নিয়ে কি করব বুঝতে পারছি না। হঠাৎই বলে বসল, "দেব, বিদিশার জায়গাটা তুই কি আমাকে দিতে পারিস না?"
আমার শরীরটা হঠাৎই কেমন কেঁপে কেঁপে উঠল। আমার বুকে ঠোঁট ছুঁয়ে আলতো প্রলেপ দিয়ে যাচ্ছে শুক্লা। ঠিক এই মূহূর্তে ওকে সান্তনা দিতে দিয়ে আমি নিজেই নিজের রাস্তা খুঁজে পাচ্ছিনা। পাগলের মত আমার বুকে মুখ ঘষে আর চুমু খেয়ে শুক্লার যেন নিজেরই হোশ ফিরলো। আমাকে বলল, "এই যা। দেখ তো ইমোশোনাল হয়ে পড়ে কিসব করে ফেললাম তোর সঙ্গে? দেব আমি সরি, ভীষন সরি, তোর সাথে এমনটা করলাম, আমার ভীষন খারাপ লাগছে।"
বলেই শুক্লা আমাকে ছেড়ে দিয়ে এবার বেশ কিছুটা দূরে চলে গেল।
।।বত্রিশ।।
কেমন যেন ঘরের মধ্যে একটা স্তব্ধতা বিরাজ করছে। আকস্মিক শুক্লার আচরণে আমি স্তম্ভিত। বুঝতে পারছি শুক্লার মনে এখন শান্তি বলে কিছু আর অবশিষ্ট নেই। কিন্তু মানসিক ভাবে আমিও কিছুটা বিপর্যস্ত। যাকে কোনদিন প্রেমিকা হিসেবে আমি ভাবিনি, বিদিশার জায়গায় যাকে কোনদিন চিন্তা করিনি, সে আমাকে এক গভীর সমস্যায় ফেলে দিয়েছে। শুক্লাকে আমি কি বলব, নিজেই বুঝতে পারছি না।
মানুষ আবেগের বশে অনেক কিছু করে বসে। পরিনতির কথা চিন্তা না করে সে তখন নিজের ইচ্ছেটাকেই বেশী প্রাধান্য দেয়। স্বভাবে, আচরণে তার পরিবর্তন ঘটে। কোন কিছু পাওয়ার আশায় সে ছটফট করে ওঠে। ভেতরে ভেতরে তার অস্থিরতা ফুটে উঠে। শুক্লা মুখে আমাকে সরি বললেও, ওর ভেতরে আমাকে নিয়ে যে একটা প্রবল চিন্তা সেটা আমি ভাল করেই উপলব্ধি করতে পারছি।
কিছুটা দূরে গিয়ে শুক্লা বলল, "দেখ, তুই আবার আমাকে নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলি। এই আমার হয়েছে বড় জ্বালা। কখন কি যে করে বসি। তোকে সব পুরোনো কথা বলতে গিয়ে নিজেই ইমোশনাল হয়ে পড়লাম। এই দেব, কি ভাবছিস? তুই সত্যিই চিন্তায় পড়ে গেলি নাকি আমাকে নিয়ে?"
আমি কোনো কথা বলছি না দেখে শুক্লা বলল, "আজ থেকে শুক্লা খারাপ হয়ে গেল তো তোর কাছে? দেখ আমার কিন্তু বন্ধু বলে কেউ আর রইলো না। সবাই আমার থেকে দূরে সরে গেল। তুইও সরে গেলি।"
নিজের মনের মধ্যে কেমন একটা দুশ্চিন্তা তৈরী হচ্ছে শুক্লাকে নিয়ে। ওর কাছে সেভাবে কঠোর হতে পারছি না। কিন্তু নরমও হতে পারছি না। কেমন যেন ডামাডোলে আমি দুলছি।
শুক্লা বলল, "বল না দেব? কাল কি হল? বিদিশা এসেছিল?"
আমার ভেতরে তখনো একটা কিন্তু কিন্তু বিরাজ করছে। বিদিশাকে নিয়ে শুক্লার এখনো এত আগ্রহ? ওর মনোভাবটা ঠিক পরিষ্কার হচ্ছে না আমার কাছে।
আমি বললাম, "ছাড় না ওসব প্রসঙ্গ। তুই তোর কথা বল। ভালোই তো লাগছিল শুনতে।"
শুক্লা বলল, "আমার কথা শুনতে বুঝি তোর ভালো লাগবে? কি একটা জীবন নিয়ে এতকাল অতিবাহিত করে দিলাম। আমার আবার জীবন কাহিনী বলে কিছু বাকী আছে নাকি?"
আমি বললাম, "তোর বরের কথা একটু শুনি। বেশ ভালই তো হয়েছিল বিয়েটা। হঠাৎ ভেঙে গেল কেন?"
শুক্লা বলল, "জোড়া লাগানোর আমি অনেক চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু আমার স্বামী আমাকে সেই সুযোগটা দেয় নি।"
কারণটা জানতে শুক্লা বলল, "আসলে আমার হাজব্যান্ড হল, বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। জামশেদপুরে ওদের আদী বাড়ী। চাকরীর দরুন, কলকাতাতেই অনেকদিন ছিল। হঠাৎই আমার শাশুড়ী এসে সব গুবলেট করে দিল।"
আমি বললাম, "সেটা কিরকম?"
শুক্লা বলল, "আমি তখন অলরেডী ফ্ল্যাটের জন্য ব্যাঙ্ক থেকে লোন স্যাংশন পেয়ে গেছি। ও আর আমি বিয়ের পর ভাড়াবাড়ীতে থাকতাম। শ্বাশুড়ি মায়ের আপত্তি হল, জামশেদপুরে যখন নিজেদের বাড়ী রয়েছে, তখন লোন টোন নিয়ে আবার এসব ফ্ল্যাট কেনা কেন? তাহলে তো ওই বাড়ীটাও শেষমেষ দেখার কেউ থাকবে না। আমার শ্বশুড় শাশুড়ীর যখন জামশেদপুরে বাড়ী রয়েছে, তখন এসব ফ্ল্যাট ট্যাট কেনার কোন দরকার নেই। আমার বর প্রথমে মায়ের কথাটার কোনো গুরুত্ব দেয় নি। পরে দেখি ও মায়ের কথায় তাল দিচ্ছে। ভীষন রাগ হল আমার। বললাম, আপনারা নিজেদের কথা চিন্তা করেন। আমার বাবা মায়ের জন্যও তো আমাকে কিছু ভাবতে হবে। মা বাবা এতকাল ধরে ভাড়া বাড়ীতে রয়েছেন, তাদেরকে যদি আমি নিজের ফ্ল্যাটে এনে তুলি। অসুবিধেটা কি?"
শাশুড়ী বলল, "তার মানে তুমি ফ্ল্যাট নিতে চাইছ নিজের বাবা মায়ের জন্য? নিজেদের কথা ভেবে নয়?"
ভীষন রাগ হল আমার। বললাম, "বাবা মা কি চিরকাল থাকবেন? তারপর তো ওই ফ্ল্যাট আমাদেরই হবে। এই সহজ কথাটা কেন বুঝতে চাইছেন না?"
আমার শাশুড়ী তারপরেও বিশ্রী ভাবে বেঁকে বসলো।"
আমি শুক্লাকে বললাম, "এটাই কি তোদের বিচ্ছেদের কারণ?'
শুক্লা বলল, "না, এরপরেও জল অনেকদূর গড়ালো। ও হঠাৎই জামশেদপুরে চলে গেল কয়েকদিনের জন্য। অফিস থেকে ছুটী নিল। বলল, বাবা মা দুজনেরই খুব শরীর খারাপ। আমাকে ওনাদের পাশে থাকতে হবে। আমি বললাম, আমি কি যাব তোমার সাথে? ও বলল, না তুমি থাকো। তাহলে তোমাকেও তো আবার ছুটী নিতে হবে।"
আমি শুক্লাকে বললাম, "তারপর?"
শুক্লা বলল, "সেই যে গেল, তারপরে দেখি আর আসার নামই করে না। আমি এদিকে রোজ ফোন করছি, ওর কাছে খবরাখবর নিচ্ছি। সেই একই কথা। না আমার এখন কলকাতায় ফেরার কোন ইচ্ছা নেই।"
আমি বললাম, "সেকী? তোর প্রতি ওর টানটা তাহলে চলে গেল? বিয়ে কেন করেছিল?"
শুক্লা বলল, "সেটাই তো কথা। বাবু চাকরি ছেড়ে একেবারে বাবা মায়ের কাছে গিয়ে হাজির হয়েছেন। ওসব শরীর টরীর খারাপ মিথ্যে কথা। মোদ্দা কথা হল, উনি চাকরী আর করবেন না। জামশেদপুরে দোকান খুলে ব্যাবসা করবেন।"
আমি বললাম, "তারপর?"
শুক্লা বলল, "তারপর আর কি? আমার এদিকে চিন্তা বাড়ছে। বাবা মাও চিন্তা করছে আমাকে নিয়ে। ফ্ল্যাটে আমি একা। রোজ শুধু অফিস করছি, কিন্তু মন আমার একেবারেই ভাল নেই। ঠিক করলাম ভাড়া বাড়ীটা আমি ছেড়ে দেবো। বাবা মায়ের কাছেই আবার ফিরে যাব। ততদিনে সল্টলেকের আমার এই নতুন ফ্ল্যাটটাও তখন তৈরী হতে শুরু করেছে। আমি বায়নাও অলরেডী করে দিয়েছি। ঠিক করলাম, ফ্ল্যাট কমপ্লিট হয়ে গেলে বাবা মাকে নিয়ে আমি এখানে চলে আসব।"
আমি বললাম, "আর তোর বর?"
শুক্লা বলল, "শেষ চেষ্টা একটা করলাম। ওকে ফোন করে আমি ট্রেন ধরে একাই চলে গেলাম জামশেদপুর। ভেতরে ভেতরে রাগটাকেও আমি প্রশমিত করে ফেলেছি। একবার ওকে অন্তত বোঝানোর চেষ্টা করব,এই আশা নিয়ে আমি জামশেদপুর রওনা দিলাম। সারাটা রাত্রি আমার ট্রেনে ঘুম এল না। কি হয় কি হয় একটা দুশ্চিন্তা মনে কাজ করছে। আমার সব আশায় জল ঢেলে দিল, আমার শশুড় শাশুড়ী। আমার বরও তখন তার বাবা মায়ের কবলে। কিছুতেই সিদ্ধান্ত পাল্টাতে রাজী হল না। উল্টে আমাকে বলে বসল, তুমি চলে এসো জামশেদপুরে। দরকার হলে ট্র্যানস্ফার নিয়ে নাও। চাকরী ছেড়ে দাও। কলকাতার প্রতি তোমার অত মায়া কেন?"
আমি চেয়ে আছি শুক্লার মুখের দিকে।
শুক্লা বলল, "তুই বল দেব? বাবা মাকে একা ফেলে, ওনাদেরকে ছেড়ে এভাবে কি চলে যাওয়া যায়? বিয়ের আগে আমি শর্তই করে নিয়েছিলাম। বাবা মাকে ছেড়ে আমি অন্য কোথাও কিন্তু যেতে পারব না। সেটা সম্ভব নয়। সব শর্তে রাজী হল। অথচ বিয়ের পর, তিনি একেবারে পাল্টে গেলেন।"
শু্ক্লাকে বললাম, "কতবছর ঘর করেছিলিস তোরা?"
শুক্লা বলল, "মাত্র এক বছর।"
আমি বললাম, "মাত্র এক বছরেই সব শেষ হয়ে গেল?"
শুক্লা বলল, "আমি শেষ করে দিতে চাইনি দেব। ওই আমাকে বাধ্য করল। কোর্ট থেকে আমাদের ছমাস সময় দিল। এই ছমাসেও তিনি মনোভাব চেঞ্জ করলেন না। বাধ্য হয়েই মিউচাল ডিভোর্সটা আমাদের করে নিতে হল।"
একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুক্লা বলল, "দেখ, এতকিছু করলাম। সেই বাবা মায়ের জন্যই আমি এত লড়াই করলাম। অথচ বাবা আর মা, দুজনকেই আমি শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারলাম না। আমার জীবনটা পুরোপুরি নিঃস্ব হয়ে গেল।"
আমি শুক্লার চোখে আবার জল দেখলাম, যেন ভাঙাচোরা একটা জীবনের মতন জীবনটাকে জোড়া লাগানোর সব প্রচেষ্টাই শুক্লার ব্যর্থ হয়ে গেছে। নতুন ভাবে বাঁচার উৎস খুঁজছে। কিন্তু অসুখী নারীমন তাকে যেন চরম বিশাদে ভরিয়ে তুলেছে।
আমার দিকে চেয়ে অনেক কষ্টে মুখে আবার হাসিটা ফেরত আনার চেষ্টা করল শুক্লা। আমাকে বলল, "আমি কিন্তু তোর বিয়েতে খুব আনন্দ করব দেব। বিদিশার সঙ্গে যদি তোর বিয়েটা হয়, তাহলে খুব মজা করব, গাইবো নাচবো। তোকে আর বিদিশাকে নিয়ে খুনসুটী করব। সারারাত হৈ হুল্লোর হবে। বাসরে মজা হবে। এই শু্ক্লাকে দেখে তুই তখন চিনতেই পারবি না। কি আমি ঠিক বলছি তো দেব?"
আমি অবাক চোখে চেয়ে আছি শুক্লার দিকে। ভাবছি, জীবনের নানা রং দেখতে যারা অভ্যস্ত। তারা কি এই রংয়ের সাথে কোন রংকে মেলাতে পারবে? এ আমি কি দেখছি? ভালোবাসার রং কি এরকমও হয়? না, আমার মাথা আর কোনো কাজ করছে না। এবারে মনে হচ্ছে, শুক্লাকেই আমাকে পরিষ্কার করে আসল কথাটা জিজ্ঞাসা করতে হবে। শুক্লা তাহলে কি তুই?.....
।।তেত্রিশ।।
মনে হল, শুক্লা আপ্রাণ চেষ্টা করছে, ওর প্রতি আমার যে ধারনাটা তৈরী হয়েছে সেটাকে নির্মূল করার। যেন অভিনয় নয়, ভেতর থেকে খুশি আর আনন্দ ফেটে পড়ছে। আমার মনের মধ্যে যাতে কোন আশংকা বাসা না বেঁধে থাকে, তার জন্য নিজেই এবার প্রাণখুলে হাসতে লাগল শুক্লা। হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে, আর বলতে লাগল, "আমি কিন্তু তোর রকমটা খালি দেখছিলাম। যেই তোকে ভালবাসার কথা বলেছি, অমনি তোর মুখটা কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেল। আরে বাবা। আমি কি অতই বোকা? যে বিদিশার জায়গাটা শুধু শুধু নিতে যাব? তুই বুঝি বিদিশাকে ছেড়ে আমাকে ভালবাসতে শুরু করে দিবি? আর আমার কথাটাও সত্যি মেনে নিবি। ওতো আমি এমনি বলছিলাম। তোকে একটু পরখ করে দেখছিলাম, আর কি? তোর সাথে একটু মজা করব না তো কি করব বল? কলেজের দিনগুলোর কথা কি তুই ভুলে গেলি?"
মনে মনে বললাম, "সব কিছু যে মজা করে হয় না শুক্লা। তোর মনের মধ্যে একটা অস্বস্তি কাজ করছে এখন। তুই যেটা বলতে চেয়েছিলিস, সেটা বলেও তুই কথাটা ঘুরিয়ে নিয়েছিস। তোর মনের ইচ্ছাটা আমি তখুনি বুঝে নিয়েছি।"
শুক্লা আবার আমার কাছে এল। আমাকে বলল, "বিদিশার কথা কিছু একটু বলবি তো? কাল শুভেন্দুদের বাড়ীতে বিদিশা এসেছিল কিনা তাও বললি না। শুধু এড়িয়ে যাচ্ছিস আমাকে? কেন আমাকে বলতে কি তোর কোন অসুবিধে আছে?"
ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আমি কিছুক্ষণ চিন্তা করলাম। তারপরে বললাম, "শুক্লা, আমাকে বড় বিপদে ফেলে দিলি তুই। এ তুই কি করলি বলতো? আমাকে বাড়ীতে ডেকে এনে মনের কথাটা বলে ফেললি। কোনদিন ভেবে দেখেছিস? আমি তোকে সেভাবে, কখনো....."
শুক্লা আমাকে বাঁধা দিয়ে বলল, "আমি জানি দেব। জোর করে কিছু হয় না। ভালবাসা প্রেম এগুলো তো ছেলেখেলা নয়। এই করলাম, আবার ছেড়ে দিলাম। আবার করলাম, আবার ছেড়ে দিলাম। ওই ভুল আমি জীবনে একবারই করেছি। কিন্তু তুই কেন করতে যাবি দেব? আমার জন্য তুই বিদিশার ভালবাসাটাকে ভুলে যাবি? এতদিন বাদে যে বিদিশা ফিরে এল, তার কি কোন দাম থাকবে না তোর কাছে? ও আমি ভুল করে ফেলেছি, দেব। একেবারে নির্বোধের মতন কাজ করে ফেলেছি। তুই প্লীজ আমাকে ক্ষমা করে দে। আমি সরি ভীষন সরি। প্লীজ দেব।"
আমি আবার চেয়ে রইলাম শুক্লার মুখের দিকে। শুক্লা বলল, "কাল কি জানি কি মনে হল, বোকার মতন শুভেন্দুকেও কিছু খারাপ কথা বলে দিলাম, বিদিশার সন্মন্ধে। পরে নিজেরই আমার অনুশোচনা হল। ভাবলাম, এ আমি কি করলাম? শুভেন্দু নিশ্চই খারাপ ভাবলো আমাকে।"
আমি বললাম, "কি বলেছিস তুই শুভেন্দুকে? বিদিশা সন্মন্ধে কিছু বলেছিস?"
শুক্লা আবার এড়িয়ে যেতে লাগল, আমার কাছে। আমাকে বলল, "না, আমি বলব না। কিছুই বলব না। তুই খালি আমাকে খোঁচাচ্ছিস। জানিস তোর মনের কি অবস্থা হবে এটা শুনলে। আমি তোর চোখে আরো খারাপ হবো। এটাই কি তুই চাস?"
এমন একটা শর্তে ফেলে দিল শুক্লা। আমার শোনার আগ্রহটা পুরোপুরি চলে গেল। মনে হল, যে ঝড়টা আমার মনের ভেতর দিয়ে এখন বইছে, আমি সত্যি বিদিশার সন্মন্ধে কোন খারাপ কথা শুনতে পারব না। যেটা সত্যি সেটাও মানতে পারব না। হয়তো মুখ ভার করে এক্ষুনি আমাকে চলে যেতে হবে শুক্লার এখান থেকে। আর কোনদিন শুক্লার মুখদর্শনও আমি করব না।
ও বলল, "জেনে রাখ দেব, বিদিশা যতই ভুল করুক। বা যতই তোর ভালবাসাকে ঠুকরে সে চলে যাক। এতদিন বাদে সে যখন ফিরে এসেছে। তাকে তাকে ক্ষমা করে দিতেই হবে। আমি যদি বিদিশার জায়গায় থাকতাম, তুই করতিস না?"
মনে মনে বললাম, "কিন্তু তুই তো আমার বাড়ীতে কাল অন্য কথাই....."
শুক্লা বলল, "বিদিশা ভীষন ভালো মেয়ে। হয়তো পরিস্থিতির চাপেই ওকে বিয়েটা তখন মেনে নিতে হয়েছিল। আমাকে ও সবই বলেছে। তোর ভালবাসার দামও সেভাবে ও দিতে পারেনি। কিন্তু সবাই তো ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে চায়। এতদিন বাদে যখন তোর কাছেই আবার ফিরে এসেছে। সেই সুযোগ কি তুই ওকে দিবি না, বল?"
মনে মনে বললাম, "সুযোগ তো আমি দিতে চাই। কিন্তু বিদিশা নিজেই তো....."
কালকের বিদিশার শেষ কথাটা শুক্লাকে বলতে গিয়েও আমি বলতে পারলাম না। শুক্লা বলল, "আমি জানি দেব, তোর মনের ভেতরে এখন যে ঝড়টা বইছে। বিদিশার সাথে যতক্ষণ না তোর দেখা হবে এই ঝড় থামবে না। তুই বিদিশাকে একটা ফোন কর। ওকে তোর বাড়ীতে ডেকে নে। নয় তুই ওর কাছে চলে যা।"
মুখটা নিচু করে ঘাড় নেড়ে আমাকে আস্বস্ত করল শুক্লা। বলল, "আমি বলছি, সব ঠিক হয়ে যাবে। বিদিশা তোর কাছেই আবার ফিরে আসবে। আমার মন তাই বলছে।"
মনে মনে বললাম, "তাই যেন সত্যি হয়। শুক্লার কথাটাই মিলে যাক। ভগবান যেন পুরোপুরি বিদিশাকে আমার কাছে পাঠিয়ে দেন।"
আরও আধঘন্টা শুক্লার সাথে নানা গল্প করে যখন ওর বাড়ী থেকে বেরুলাম, মনে হল, এতদিন ধরে যাকে শুধু বন্ধু হিসেবেই দেখেছি, সেই শুক্লা আমার কাছে নিজের স্বার্থ ভুলে গিয়ে সত্যিকারের বন্ধু হিসেবেই নিজেকে আবার প্রমান করল। ঠিক এই মূহূর্তে যে নিজের ভালটা না ভেবে আমার ভাল ছাড়া জীবনে আর কিছু চায় না।